ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কক্সবাজারে ফুটপাত ভাড়া দিয়ে দিনে লাখ টাকা চাঁদাবাজি!

প্রকাশনার সময়: ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১৮:৪২

কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোনের কলাতলীর ফুটপাত ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি চাঁদাবাজ চক্র। এরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে লাইনম্যান হিসাবেই পরিচিত। পর্যটক সংশ্লিষ্ট, জিপ মিনি কার, সিএনজি, পাকিং ও শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দিনে ৫০-৪০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করেন। এ হিসাবে দিনে কম করে হলেও এক লাখ টাকার চাঁদা আদায় হয়।

ভুক্তভোগীদের একটি সূত্র জানায়, কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু সন্ত্রাসী এই চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এছাড়া ডলপিন মোড়সহ সুগন্ধা পয়েন্ট এলাকায় পুলিশ-পৌরসভার নামে তোলা হয় চাঁদা।

ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। মাঝেমধ্যে ফুটপাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করলেও চাঁদাবাজরা বরাবরই থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাহিরে।

ফুটপাতের ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকরা জানান, মোর্শেদ নামে এক আওয়ামী লীগ নেতার ছত্রছায়ায় ১৫ থেকে ২০ জনের একটি চক্র পৌরসভার নাম ভাঙ্গিয়ে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করে থাকেন। চাঁদা না দিলে বন্ধ করে দেওয়া হয় ব্যবসা ও পরিবহন চলাচল। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে মাঝে মাঝে মারধরও করা হয় বলে জানান তারা।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, কলাতলী মোড়ে কক্সবাজার ইউনিভার্সিটি রোডে পর্যটকের গাড়ি পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে না। তাদের কাছ থেকেও চাঁদা নেয় এই চক্রটি। মাঝেমধ্যে কোনও পর্যটক চাঁদা দিতে না চাইলে গাড়ি ভাঙচুর ও মারধরের মত ঘটনাও ঘটে। চাঁদাবাজ চক্র এতটাই ভয়ংকর ও প্রভাবশালী যে, কয়েকজন পর্যটক তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরে অভিযোগ দিয়েও কোন সুরাহা পায়নি। ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও ভয়ে মুখ খুলেন না তাদের বিরুদ্ধে।

জাফর আলম নামের এক পরিবহন মালিক জানান, ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা এক সাংবাদিক দম্পতি নিয়ে সারাদিন ঘোরাঘুরি করার পর রোববার রাত ৯টার দিকে কক্সবাজার ইউনিভার্সিটির সামনে টংয়ের দোকানে চা খাওয়ার জন্য দাড়ানো হয়। এ সময় একজন ছেলে এসে পার্কিং বাবদ চাঁদা দাবী করেন। তিনি রাস্তায় পার্কিংয়ের জন্য কিসের টাকা জিজ্ঞেস করলে ওই ছেলে ফোন করে ১৫-২০ জন লোক ডেকে আনেন। এরপর কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে পর্যটক সাংবাদিক দম্পতি ও আমাকে গাড়ি সরানোর জন্য খারাপ ব্যবহার করেন তারা। এক পর্যায়ে তারা কোনও কথা না শুনে তাকে মারধর করে গাড়ি বের করে দেয়। পরে স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক কারণ জানতে চাইলে তাদের সাথেও মারমুখী আচরণ করেন তারা।

তথ্য বলছে, পৌরসভা ও পুলিশের নাম ভাঙিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করেন জহির ও মফিজ নামের দুই লাইনম্যান। আবার তাদের কাছ থেকে ও ফুটপাতের ৫ শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পৌরসভার নামে চাঁদা তোলেন কলাতলী ঝরঝরি পাড়ার মোহাম্মদ রিদুয়ান, একই এলাকার মোহাম্মদ আরফাদ উদ্দিন জুয়েল, আবু শামার ছেলে মোহাম্মাদ আবু তাহের, কলাতলী দাওয়াত রেস্তোরার মালিকের ছোট ভাই সাহাব উদ্দিন শিহাব ওরফে পুতিয়াসহ ১৫ থেকে ২০ জনের একটি চক্র।

অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে সাহাব উদ্দিন শিহাব ওরফে পুতিয়া ও মহফিজ বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ নেতা মোর্দেশ ভাইয়ের হয়ে এ চাঁদার টাকা আদায় করি। কিছু বলতে চাইলে তাকে বলেন।

পর্যটকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়ে তারা বলেন, যেই হোক না কেন কলাতলীতে গাড়ি দাড়ালে আমাদের টাকা দিতে হবে।

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, চাঁদাবাজির অভিযোগ পেয়ে কলাতলীতে অভিযান চালিয়ে গাড়ি ও ফুটপাত থেকে কিছু দোকান সরিয়ে দেয়া হয়। অভিযানের পর পৌরসভা ১২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ আলম পৌর আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক নেতাকে সাথে নিয়ে পুলিশ কার্যালয়ে আসেন। এরপর বলেন অভিযুক্তরা আমাদের আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে তাই হাত খরচের জন্য তারা কলাতলীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে খরচের টাকা নেয়। চাঁদাবাজি বন্ধে ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, এদের চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। এদের উৎপাত সারা বছরই সইতে হয়। এদের বিরুদ্ধে কথা বললে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। তাই চাঁদা দিয়েই ব্যবসা করি। অল্প পুঁজি দিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা করি। ব্যবসা না করলে খাব কি?

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিউজে আমাদের নাম প্রকাশ করলে কালকে থেকে আর বসতে দিবে না তারা। তাই চাঁদাবাজির বিষয়ে কারও কাছে মুখ খুলি না। কারণ তারা খুব প্রভাবশালী।

অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করেন কক্সবাজার পৌরসভা ১২ নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ আলম। তিনি বলেন, রাজনীতি যখন করি কিছু ছেলে সাথে রাখতে হয়। তাদেরকে চালানোর জন্য গাড়ি ও ফুটপাত থেকে টাকা তোলা হয়। ওই টাকা আমার দরকার হয় না। আমি সব টাকা তাদের ভাগ করে দিয়ে দেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হোটেল জোনের এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, কলাতলীসহ আশেপাশের এলাকায় কিছু হকারসহ কয়েকটি গাড়ির পার্কিং রয়েছে। চাঁদাবাজরা তাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। এসব চাঁদাবাজকে স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ শেল্টার দেয়। স্থানভেদে ৫০ থেকে শুরু করে ৮০, ১০০, ১৫০, ২০০ এবং ৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

তিনি বলেন, গড়ে ১০০ টাকা করে চাঁদা হিসাব করলেও দিনে এক লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। আর মাসে এ অঙ্ক দাঁড়ায় ৩০ লাখে। তার মতে, মাসে এ হিসাবের দ্বিগুণ চাঁদা আদায় হয়। চাঁদাবাজ দমন করে সরকার যদি এ টাকা নিত, তবে বছরে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন অভিযান করলে কিছুক্ষণের জন্য তারা আড়ালে চলে যায়। পরে বেরিয়ে এসে আবারও চাঁদাবাজিতে নামে। পৌরসভা ও জেলা প্রশাসন যদি প্রকৃত হকারদের কাছে ফুটপাত ইজারা দিত, তাহলে এমন অবস্থা হতো না।

পৌরসভার নামে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান বলেন, কলাতলীতে পৌরসভার পক্ষ থেকে কাউকে চাঁদা নেওয়ার জন্য বলা হয়নি। এ বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি ঢাকায় আছি ফেরার পর খোজ নিয়ে এই চাঁদাবাজ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ করব।

জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এর আগেও এক পর্যটকের প্রাইভেট গাড়ি ভাঙ্গচুর ও চালককে মারধর করে একটি অভিযোগ পেয়েছিলাম। পর্যটক ও স্থানীয়দের কথা মাথায় রেখে অধিকতর তদন্ত করে অভিযুক্ত চাঁদাবাজ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

নয়াশতাব্দী/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ