ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

খালের প্রবাহ বন্ধ করে আ.লীগ নেতার মাছ চাষ

ভেঙে পড়েছে সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা
প্রকাশনার সময়: ২২ আগস্ট ২০২৩, ১৮:৩৪

কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা এবং পিএমখালী ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পাতলী খাল। এই উম্মুক্ত খালে মৎস্য আহরণ করেই চলত দুই পাড়ের সহস্রাধিক পরিবারের সংসার। এই খালের দেড় কিলোমিটার জুড়ে দুটি বাঁধ দিয়ে জবরদখল করে মাছ চাষ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে পিএমখালী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে। ফলে বিপাকে পড়েছে ওই এলাকার লোকজন।

সরেজমিনে দেখা যায়, পিএমখালী ইউনিয়নের উত্তর পাতলী মোহসিনিয়া পাড়া পর্যন্ত মাঝখানের অংশের প্রায় দেড় কিলোমিটার খালে দুটি বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এতে খালের জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আবার বাঁধের পাশে ঘর নির্মাণ করে সেখানে মাছের খাবারসহ বিভিন্ন মালামাল রাখা হয়েছে।

স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের লোকজনই প্রভাব খাটিয়ে খালটিতে মাছ চাষ করে। খালে বাঁধ দেওয়ার কারণে একদিকে এটি ছোট হচ্ছে, অপরদিকে স্থানীয় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তাদের মতে, ভরাট হয়ে যাওয়া এই খালে চাষাবাদ ও মৎস্যজীবীদের সুবিধার্থে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে খালটির কিছু অংশ খনন করে বিএডিসি কর্তৃপক্ষ। খননের পর বাঁধ দিয়ে মাছ চাষে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত এই খাল আজ বিপন্ন হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বাঁধের কারণে খালের প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে ২০ হেক্টর জমির ধানসহ বিভিন্ন শাক-সবজির খেত। স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খালটির বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন জন বাঁধ দিয়ে কেউ মাছ চাষ করছে, কেউবা ভরাট করে বাড়িঘর তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ফলে শতবর্ষী খালটি শিগগিরই তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। জবরদখলে খালটি বিপন্ন হওয়ায় ঝিলংজা এবং পিএমখালী ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে কৃষি সেচ ব্যবস্থা এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

বাঁধের কারণে দীর্ঘ খালটির আশপাশের কয়েক গ্রামের সহস্রাধিক কৃষকের সেচনির্ভর কৃষি যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে বিস্তৃত জনপদ। জবরদখল করা খালটি উদ্ধার চেয়ে সম্প্রতি স্থানীয় কৃষক ও জেলেরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ করার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি উপজেলা প্রশাসন।

স্থানীয় কৃষকরা অভিযোগ করেন, নুরুল আবছার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পাতলী খালের অংশে একাধিক বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। স্থানীয় কৃষক ও গ্রামবাসী বাধা দিলেও সব বাধা উপেক্ষা করে তিনি পানি নিষ্কাশন বন্ধ করে জবরদখল করে নেন খালটি।

স্থানীয় কৃষক মো. মাসুদ জানান, খালটি বন্ধ করে দেওয়ায় আবাদি জমিতে তীব্র জলাবদ্ধতা হয়। পানি নিষ্কাশনের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতার কারণে নষ্ট হচ্ছে ফসল। এছাড়াও ইরি মৌসুমে পানির সংকটে ইরি চাষ ব্যাহত হচ্ছে।

তথ্যসূত্রে জানা যায়, ঝিংলজা ও পিএমখালী ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়াউর রহমান নিজে এসে খালটি খনন করেছিলেন। কিন্তু কালক্রমে খালটি নানা কারণে ছোট ও ভরাট হয় গেছে। তার উপর রয়েছে দখলদারদের থাবা। এরমধ্যে ঝিলংজার মাস্টার পাড়ায় দখল হয় সবচেয়ে বেশি।

অভিযোগ দায়েরকারী কৃষক নুরুল কবির জানান, ঐতিহ্যবাহী খালের উপর বাঁধ দেয়ায় জমিতে সেচ দিতে পারছেন না শতশত কৃষক। লাখ লাখ টাকা খরচ করে খালটি খনন করার পরও বর্তমানে তাদের কোন কাজে আসছে না খালটি।

স্থানীয় জেলে মোজাম্মেল হক বজল কবির ও আবছার বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই খাল থেকে মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। আমাদের প্রায় সহস্রাধিক জেলে পরিবারের সংসার চলে এই খালের মাছ শিকার করে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালে বাঁধ দেন। ফলে এ খালে মাছ শিকার ও চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। তারা এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের সহযোগিতা কামনা করেন।

জানতে চাইলে খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের বিষয়টি স্বীকার করেন অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আবছার। তিনি বলেন, খালটিতে সময়মতো পানি না থাকার কারণে জমিতে সেচ দিতে অসুবিধা হয়। একারণে বাঁধ দিয়ে পানি জমা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি কিছু মাছও চাষ করা হয়েছে।

তাদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, তারা অহেতুক এইসব অভিযোগ করছেন। এতে কারো তেমন কোন ক্ষতি হওয়ার কথা না। তারপরও প্রশাসন যদি তাই মনে করে, তারা বাঁধগুলো কেটে দিতে পারেন।

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি শামশুল আলম শ্রাবণ বলেন, নদী-খাল কোনো ব্যক্তিমালিকের হয় না। এগুলোর মালিক জনসাধারণ। নদী-খালের পানি ও মাছের ওপর কোনো ব্যক্তি, সংঘ, সংস্থা বা দলের একচ্ছত্র অধিকার নেই। দখল-দূষণের ফলে নদ-নদীর গভীরতা কমে যায়। ফলে নদীতে বসবাস করা জলজপ্রাণীর অস্তিত্ব হারানো আশঙ্কা থাকে। নদী সরু ও গভীরতা কমে যাওয়ায় আশপাশের এলাকা বর্ষাকাল ছাড়াও জোয়ারে প্লাবিত হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, নদ-নদী রক্ষার বিষয়ে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। এতে প্রতিটি জেলায় দখলদারদের তালিকা করার নির্দেশনাও রয়েছে। দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে অতিদ্রুত খালটি দখলমুক্ত করতে হবে।

কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, পিএমখালীতে খাল দখল করে মাছ চাষের বিষয়টি আমরা জেনেছি। সময়ের অভাবে বাঁধ অপসারণ করতে যেতে পারছি না। প্রভাবশালী যতবড় শক্তিশালী হোক সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করতে অতিসত্ত্বর অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

নয়া শতাব্দী/এসএ/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ