ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পদ্মায় ভিটে বাড়ি ভাঙলেও মনোবল ভাঙেনি আসিফের

প্রকাশনার সময়: ০৩ আগস্ট ২০২৩, ১৮:১৬

তিন বছর আগে পদ্মার প্রবল ভাঙ্গণে বাড়ি-ঘর বিলীন হয় আসিফদের। তখন সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। সবকিছু হারিয়ে অন্য আট/দশটি ছেলের মতো ওখানেই থেমে যেতে পারত তার লেখাপড়া।

জীবিকার তাগিদে বাবার সাথে নেমে যেতে পারত ঘাটের হকারি পেশায়। কিন্তু সে তা করেনি। এক মূহুর্তের জন্যও সে মনোবল হারায়নি। চালিয়ে গেছে এক কঠিন সংগ্রাম। যার ফলস্বরূপ এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলার দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। অদম্য মেধাবী ও বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী আসিফের এ সাফল্য প্রত্যাশিতই ছিল। তারপরও তার সাফল্যে পরিবার ও শিক্ষকরা খুবই খুশি।

আসিফ প্রামাণিক ও তার পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার ছোট ভাকলা ইউনিয়নের স্বরূপারচক গ্রামে বসবাস করেন। গ্রামের জনৈক আলাউদ্দিন সরদারের কাছ থেকে বার্ষিক ৪ হাজার টাকায় লিজ নেওয়া ৪ শতাংশ জমিতে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। নদীতে বাড়ি-ঘর বিলীন হওয়ার আগে উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের লালু মণ্ডলের পাড়ায় তাদের বসতি ছিল।

আসিফের বাবা বাদশা প্রামাণিক দৌলতদিয়া ঘাটে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। চারটি ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে তার ছয় সদস্যের সংসার। আসিফ তার বড় সন্তান। তার সামান্য আয়ে সংসার চলে টানাপোড়েনের মধ্যে। এরই মধ্যে পদ্মার ভাঙনে ভিটে মাটি হারিয়ে তারা অসহায় হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে নিজের পড়াশোনা সামলে আসিফ টিউশনি করে পরিবারকে কিছুটা সহযোগিতা করে।

বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) দুপুরে আসিফদের বাড়িতে দেখা যায়, জরাজীর্ণ একটি টিনের ছাপরা। ঘরের এক পাশে থাকে আসিফ, আরেক পাশে দুই ভাই-বোনকে নিয়ে থাকেন তার মা–বাবা।

আসিফের মা আসমা বেগমের চোখে আনন্দাশ্রু। তিনি বলেন, পরিবারের সবার বড় আসিফ। এরপর মেয়ে দীপা। সে দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ে। অভাবের কারণে সে দৌলতদিয়ার মুন্সিবাজারে নানা বাড়ি থেকে পড়াশোনা করে। আরেক মেয়ে দিয়া প্রথম শ্রেণিতে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। সবার ছোট ছেলে আহাদের বয়স আড়াই বছর। আসমা বেগম বলেন, এত কষ্টের মধ্যেও ছেলে ভালোভাবে পাশ করেছে দেখে খুব খুশি হয়েছি।

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, পরীক্ষার আগে আসিফ অনেক কষ্ট করে দিনরাত পড়ালেখা করেছে। অথচ আমি তাকে একটু ভালো খাবারও দিতে পারিনি। অথচ তিন বছর আগেও আমাদের জমি-জমা, বাড়ি-ঘর সবই ছিল। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে আমরা এখন নিঃস্ব। আমার ভাঙা সংসারে ছেলে আসিফই এখন আশার প্রদীপ।

আসিফের বাবা বাদশা প্রামাণিক বলেন, পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতিদিন লঞ্চ-ফেরি এবং ঘাট এলাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি করে যা আয় হতো, তা দিয়ে মোটামুটি ভালোই চলত সংসার। কিন্তু এখন এদিকে যাত্রী ও যানবাহন কমে যাওয়ায় বেচাকেনা একেবারে কমে গেছে। তারপর হকার বেশি হওয়ায় তিন দিন পর এক দিন বিক্রির সুযোগ পান। দিন শেষে ৩০০-৪০০ টাকার মতো থাকে। তা দিয়ে কোনোভাবে দিন পার করছেন। এমতাবস্থায় আসিফ পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে। এতে আমি একদিকে খুব খুশি। আবার তার পরবর্তী পড়ালেখা কিভাবে চালাবো তা নিয়েও অনেক দুশ্চিন্তায় আছি।

আসিফ জানায়, আমি যে কোনো কষ্ট সইতে প্রস্তুত আছি। তবুও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চাই। আমার স্বপ্ন বড় হয়ে একজন ভালো চিকিৎসক হব। দেশের মানুষকে সেবা করব।

দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহম্মদ সহিদুল ইসলাম বলেন, আসিফ অদম্য মেধাবী একটা ছেলে। পড়ালেখা ছাড়া বিতর্ক, কুইজ, সাধারণ জ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে। এজন্য জেলা-উপজেলার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি বহু পুরস্কারও অর্জন করেছেন। আমরা বিগত ৫ বছর তাকে সম্ভাব্য সকল ধরনের সহযোগিতা দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। সে আমাদেরকে গর্বিত করেছে। আমি তার মতো মেধাবীর পাশে দাঁড়াতে সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

নয়া শতাব্দী/এসএ/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ