বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ভবনের পাশে ২০০৮ সালে ৫০০ শয্যার ১০ তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২০১০ সালের জুনে ঐ ভবন স্থানান্তরের কথা ছিল। কিন্তু নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে পাঁচ তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়। এরপর এক যুগ কাজ বন্ধ থাকে।
২০২০ সালে করোনা ওয়ার্ড চালুর জন্য তড়িঘড়ি করে ঐ ভবনটি সংস্কার করে প্রথমে ১০ বেড ও পরবর্তী সময়ে ৩০০ বেড পর্যন্ত করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে হাসপাতালের মূল ভবনে মেডিসিন ওয়ার্ডের দূরাবস্থা লাঘবে এ ভবনটিতে প্রথমে চারটি ইউনিট স্থানান্তরিত করা হয়। পরে নিচ তলায় আর একটি ইউনিট করা হয়। কিন্তু তা চালু করা হয়নি। মূল নকশায় ১০ তলা এ ভবনে মূলত ছয় তলা থেকে রোগী থাকার কথা ছিল।
বর্তমানে পাঁচ তলা পৃষ্ঠা ২ কলাম ৪ ভবনটিতে মেডিসিন ওয়ার্ডে নানা অব্যবস্থাপনা দেখা যাচ্ছে। চারদিকে দুর্গন্ধ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, আলো, বাতাস চলাচলের পথ নেই। চারটি ওয়ার্ডে ধারণক্ষমতার তিন থেকে চার গুণ রোগী ভর্তি রয়েছে। দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।
হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল ইসলাম সংকটের কথা স্বীকার করে জানান, মূল ভবনের চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়েই চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে। যেখানে মূল ভবনেই জনবল নেই তিন ভাগের এক ভাগ। তার ওপর নতুন এ ইউনিট চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সবাইকেই। ভবনটিতে শৌচাগার ও আলো, বাতাসের জন্য গণপূর্তকে বারবার চিঠি দিলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্তের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, যে ভবনটিতে মেডিসিন ওয়ার্ড স্থাপন করা হয়েছে, মূল নকশায় তার নিচতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত কোনো রোগী থাকার কথা নয়। সেখানে মূলত প্রশাসনিক ব্লক, অপারেশন থিয়েটার ও বহির্বিভাগ থাকার কথা ছিল। মূলত ছয় তলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত রোগী থাকার কথা, যা এখনো নির্মাণ হয়নি। তারপরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত কয়েকটি শৌচাগার করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে এখন দৈনিক রোগীসহ ১ হাজার ২০০ মানুষ থাকায় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মেডিসিন বিভাগের চারটি ইউনিট স্থানান্তরের পর চরম অচলবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ভবনটির দোতলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত দুর্গন্ধ। পর্যাপ্ত আলো বাতাস না থাকায় সুস্থ মানুষেরও দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। হাসপাতালের পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডের শৌচাগার ব্যবহারের অনুপযোগী। ময়লা-আবর্জনায় সয়লাব। যেকোনো রোগী শৌচাগারে গেলে পা পিছলে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
পুরুষ ওয়ার্ডে চিকিৎসারত রোগী মো. জামাল হোসেন বলেন, তিনি ভাষানচর থেকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে দুই দিন আগে ভর্তি হয়েছেন। তাকে যে বিছানাটি দেওয়া হয়েছে, তা ছিল অপরিষ্কার, এমনকি চাদরটিও ধোয়া হয়নি বলে মনে হচ্ছে, তাই বাধ্য হয়ে নিজের আনা একটি চাদর বিছানায় পাতা হয়েছে। শৌচাগারে যেতে ভয় হচ্ছে, যে নোংরা।
রোগীর সঙ্গে আসা মাহামুদ হাসান বলেন, ‘আমি হাসপাতালের শৌচাগারে না গিয়ে বাইরের মসজিদের শৌচাগারে যাই, কারণ হাসপাতালের যে শৌচাগার, সেখানে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই।’
চারটি ইউনিটের অনুমোদিত সবগুলো বেড ঐ ভবনের দুই তলা থেকে পাঁচ তলায় স্থান সংকুলান হয়নি। ফলে বিপুল সংখ্যক মুমূর্ষু রোগীকে মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। সময়মতো চিকিৎসক ও নার্সদের না পাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে পটুয়াখালী থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মেডিসিন-৩ ইউনিটের রোগী ফারজানা বেগমের স্বজন শিউলি বেগম বলেন, ঈদের দ্বিতীয় দিন বিকেলে পেটে ব্যথা নিয়ে আমরা মেডিকেলে ছোট বোনকে নিয়ে আসি। আসার পর থেকে কোনো বড় ডাক্তার পাইনি।’
ডিউটিরত নার্সরা জানান, ইউনিট-৩-এর ধারণক্ষমতা ৪৮ জন রোগীর, সেখানে রোগী থাকছে ২০০ এর বেশি। একজন রোগীর সঙ্গে গড়ে দুই জন করে স্বজন থাকায় তাদের পক্ষে সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এ ইউনিটের ওয়ার্ড মাস্টার জুয়েল চন্দ্র শীল হাসপাতালে উপস্থিত না থাকায় তার মোবাইল ফোনে বার বার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অভিযোগ রয়েছে ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে ওয়ার্ড মাস্টারসহ অধিকাংশ কর্মচারীরা মঙ্গলবার পর্যন্ত কর্মস্থলে যোগদান করেননি। হাসপাতালের পরিচালক জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ