ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ আনন্দ

সব থেকেও যাদের কেউ নেই

প্রকাশনার সময়: ২৯ জুন ২০২৩, ২২:২৪

একসময় বেসরকারি চাকরি করতেন জবেদ আলী। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার বেশ ভালোই চলছিল। সন্তানদের বড় করে বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর ছেলেরা আলাদা হয়ে যায়। স্ত্রী এবং নিজের নামে সামান্য যে জমি ছিল, সেই জমি দুই ছেলেকে লিখে দেন। আর এরপরই তার জীবনে নেমে আসে অমানিশা অন্ধকার। ছেলেদের অবহেলা আর ছেলে বউদের অত্যাচারে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন বৃদ্ধ জবেদ আলী ও তার স্ত্রী।

একসময় তাদের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। আজ থেকে ৬ বছর আগে বৃদ্ধাশ্রমে ওঠেন এই দম্পতি। কিছুদিন পর স্ত্রীও মারা যান। পুরোপুরি একা হয়ে যান জবেদ আলী। ঈদের দিন ছেলে-মেয়ে ও নাতি, নাতনীদের দেখতে না পেরে বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালে নীরবে চোখের জল ফেলছেন জবেদ আলী।

এ দৃশ্য শুধু জবেদ আলীর নয়, মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রমে মুখ লুকিয়ে নীরবে কাঁদছেন বগুড়ার আব্দুস ছামাদ (৭২), আব্দুর রশিদ (৭৭), গোবিন্দগঞ্জের আবু তাহেরসহ ৪২ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।

বর্তমানে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটছে ১০৩ বছর বয়সী জবেদ আলীর।

বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) ঈদের দিন দুপুরে গোবিন্দগঞ্জের ছোট সোহাগী গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রমে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় উপজেলার কালিডোবা গ্রামের জবেদ আলীর।

সন্তানদের স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জবেদ আলী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ছেলে-মেয়েদের ছাড়া ঈদে কোনো আনন্দ নেই। এই কষ্ট কেউ অনুভব করতে পারবে না। এমন সন্তান দুনিয়াতে যেন আর কারো না থাকে।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরের পথ ছোট সোহাগী গ্রাম। গ্রামটি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বরে স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে উঠে এই মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রমটি। বিভিন্ন মানুষের অনুদানে চলে এটি। বর্তমানে এখানে বাবা-মা আছেন ৪২ জন। এর মধ্যে বৃদ্ধা মা ২৬ জন আর বৃদ্ধ বাবা আছেন ১৬ জন। অনেককেই রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে এই আশ্রমে। তাদের সবারই ঈদ কাটছে পরিবারহীন।

অতীতের সুখের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে এই আশ্রমে জীবনযাপন করছেন এসব অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মা। ঈদের এ আনন্দের দিনে প্রিয় সন্তানের জন্য মুখ লুকিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছেন তারা। জীবনের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানদের জন্য। অথচ আজ শেষ বয়সে, সেই সন্তানদের কেউ পাশে নেই। বৃদ্ধাশ্রমে যত্নে থাকলেও মনে আজ আনন্দ নেই এসব বাবা-মা'র। সন্তানের জন্য প্রতি মুহূর্তে হৃদয় কাঁদছে তাদের।

বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বৃদ্ধা মেহেরুননেছা। বয়স প্রায় একশ। স্বামী মারা যাওয়ার পর বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে দুই ছেলে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। কেউ মায়ের খোঁজ রাখেন না। কয়েক দিন রাস্তায় পড়ে ছিলেন। এরপর ঠাঁই হয় এ বৃদ্ধাশ্রমে। ছেলে-মেয়ে থেকেও তিনি যেন নিঃসন্তান।

এখানকার আরেক আশ্রিতা ভরশী মাহমুদ (১০৮)। একই উপজেলার চক বিরাহীমপুর গ্রামে বাড়ি। এক ছেলে আছে। আছে নাতি-পুতিও। বিয়ের পর সেও আর বৃদ্ধ বাবার খোঁজখবর রাখেন না। বাধ্য হয়ে এখানেই প্রায় ৪ বছর ধরে বসবাস করছেন।

তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, এখানে থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। ঈদের দিনে ভালো পোশাক আর ভালো ভালো খাবার দেওয়া হয়েছে। কোরবানিও করা হয়েছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবাও দেওয়া হয়। কিন্তু কোথাও যেন কি এক শূন্যতায় কিছুই ভালো লাগে না।

মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আপেল মাহমুদ বলেন, আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি একটি স্বেচ্ছাশ্রম প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা আছেন, তারা সবাই কারও না কারও বৃদ্ধ বাবা-মা। আমরা তাদেরকে নিজেদের বাবা-মা'র মতো আদর-স্নেহ করি। এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দাই অসুস্থ। সময়মত তাদের গোসল, খাওয়া-দাওয়া করাতে হয়। অনেককে আবার মুখে তুলে খাওয়াতে হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন দাতা সদস্য ও অন্যদের অনুদানে চলে এটি। এসব বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য অনেকেই এবারের কোরবানির ঈদে গরু, ছাগলসহ নগদ অর্থ অনুদান দিয়েছেন। তাদেরকে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিবেন ইনশাআল্লাহ। এছাড়া তাদের নতুন পোশাক দেওয়া হয়েছে। আরও বৃদ্ধ ব্যক্তির থাকার ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হতো। এজন্য সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

নয়া শতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ