বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের আশা জাগাচ্ছে ড্রাগন ফল। ড্রাগন ফল চাষ করে ভাগ্যবদল হয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলের বহু কৃষকের। ফলটি দেখতে অনেক সুন্দর। সুস্বাদু। মানে ভালো। বাজারে চাহিদাও প্রচুর। বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিরা এখন ড্রাগন চাষে ঝুঁকে পড়েছেন।
সময় বেশি লাগলেও কৃষকরা অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে অধিক লাভবান হচ্ছে ড্রাগন ফল চাষে। এতে তাদের অভাব মোচন হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে চাষে আগ্রহ বেড়েছে।
খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকার মাটিতে আগে ফল তো দূরের কথা অন্যান্য ফসল উৎপাদন কম হতো। কিন্তু এখন বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে সোনা ফলছে। স্ট্রবেরি, লাল তরমুজ, পেয়ারা চাষের পাশাপাশি দিন দিন ‘ড্রাগন’ ফলের চাষ বাড়ছে। ‘ড্রাগন’ চাষ অধিক লাভজনক এবং অনেকদিন স্থায়ী হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিরা এই ফল চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ড্রাগন হলো ক্যাম্প প্লান্ট জাতীয় ফসল। আর ক্যাম্প প্লান্টের বৈশিষ্ট্য হলো- এই জাতীয় ফসল মরুভূমির মধ্যেও বেঁচে থাকে। পানির তেমন প্রয়োজন হয় না। ড্রাগন ফল প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে বেঁচে থাকে। তাই বরেন্দ্র অঞ্চলের শুষ্ক জমিতে দিন দিন ড্রাগন ফল চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রাজশাহী জেলার কমবেশি সব উপজেলাতেই ড্রাগন ফল চাষ হচ্ছে। বর্তমানে রাজশাহীর নগরীর বাসিন্দারা সখের বসে অনেকে ছাঁদে ড্রাগন ফল চাষ করেছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে- রাজশাহীতে গত বছর (২০১৯-২০২০ অর্থবছর) ৭ দশমিক ৫৬ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফল চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে রাজশাহী নগরীর মতিহার থানা এলাকায় ০.৫ হেক্টর, পবা উপজেলায় ০.৫০ হেক্টর, জেলার তানোর উপজেলায় ০.৮০ হেক্টর, মোহনপুর উপজেলায় ০.১৩ হেক্টর, দুর্গাপুর উপজেলায় ০.১৩ হেক্টর, পুঠিয়া উপজেলায় ৩ হেক্টর, গোদাগাড়ী উপজেলায় ২ হেক্টর এবং চারঘাট উপজেলায় ০.৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করা হয়।
চলতি অর্থবছরে (২০২০-২০২১) রাজশাহীর এই বরেন্দ্র অঞ্চলে ২৭.০৮ হেক্টর (নগরীর বোয়ালিয়া থানা এলাকায় ০.১৫ হেক্টর, পবা উপজেলায় ০.৫০ হেক্টর, জেলার তানোর উপজেলায় ০.৮০ হেক্টর, মোহনপুর উপজেলায় ০.১৩ হেক্টর, দুর্গাপুর উপজেলায় ০.৫০ হেক্টর, পুঠিয়া উপজেলায় ৪ হেক্টর, গোদাগাড়ী উপজেলায় ২০ হেক্টর এবং চারঘাট উপজেলায় ১ হেক্টর) জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, ‘২০১৯-২০২০ অর্থবছরের চেয়ে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রাজশাহী অঞ্চলে ১৯.৫২ হেক্টর বেশি জমিতে ড্রাগনের চাষ হয়েছে। আগামীতে রাজশাহী অঞ্চলে আরও বেশি জায়গায় এই ড্রাগন চাষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯-২০২০ বছরে রাজশাহীতে ৭.৫৬ হেক্টর জমিতে ৯০.২১ মেট্রিকটন ও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২৭.০৮ হেক্ট্রর জমিতে ৩২২.৬৫ মেট্রিকটন ড্রাগন ফলের চাষ হয়েছে।’
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা কুমারী মিষ্টি রানী নয়া শতাব্দীকে জানান, গোদাগাড়ী উপজেলার দুইটি ইউনিয়নে (গোগ্রাম ও মাটিকাটা ইউনিয়ন) বসন্তপুর, ধাতমা, বড়শীপাড়া এবং ফরাদপুরে মোট ৫২ বিঘা জমিতে ৩টি ড্রাগন ফলের বাগান রয়েছে। নিয়মিত এসব ড্রাগনের বাগানে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। তিনি বলেন, ড্রাগন চাষের চারা থেকে শুরু করে যাবতীয় উপাদান গোদাগাড়িতে পাওয়া যায়।
এখানে কৃষকরা ড্রাগন চাষ করে অনেক লাভবান হচ্ছে। আগে ড্রাগন ফলের দাম ছিল কেজি প্রতি ৮শত টাকা এখন অধিক চাষের কারণে ড্রাগন ফলের দাম কমে এসেছে। বাজারে এখন সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন ফল পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ড্রাগন অনেক পুষ্টিকর ফল। এই ফল চাষের মাধ্যমে দেশে পুষ্টি চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এছাড়া অধিক লাভবান হওয়ায় অনেক চাষি ড্রাগন চাষে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
বসন্তপুর গ্রামের ড্রাগন চাষি হেলাল হোসেন জানান, ‘ প্রায় ৪৫ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করছি। এতে খরচ হলেও ড্রাগন ফল বিক্রি করে লাভবান হয়েছি। তিনি জানান, ড্রাগনের গাছে ফল আসতে দেড় বছর সময় লাগে। কিন্তু একবার জমিতে গাছ জমে গেলে বহুদিন ফল পাওয়া যায়। এখন বাগান থেকে ড্রাগন ফল নামানো শুরু হয়েছে। অর্থাৎ ড্রাগন ফলের উৎপাদন সময় হলো জুন থেকে শুরু করে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত।’
উৎপাদন খরচ সম্পর্কে তিনি বলেন, এক বিঘা জমিতে ২২০টি পিলার ও হ্যাঙ্গার লাগে। এছাড়া ড্রাগন উৎপাদনে টায়ারের প্রয়োজন হয়। সবমিলিয়ে চারা ক্রয় থেকে ড্রাগনের ফলন (১৮ মাসে) বিঘা প্রতি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকার মত খরচ হয়।’ ড্রাগনের দাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো অর্থাৎ বড়টা গত বছর সাড়ে ৪০০ টাকা, মাঝাড়ি ধরনেরটা ৩০০ টাকা এবং নিম্নমানেরটা সর্বনিম্ন ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। তবে এবছর করোনার কারণে সবচেয়ে ভালো ড্রাগন বিক্রি করতে হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি দরে।’
রাজশাহী নগরীর মেহেরচন্ডী এলাকার বাসিন্দা মাজেদুল ইসলাম রাতুল বলেন, আমি সখের বসে বাড়ির ছাদে ১০ টি ড্রাগনের চারা রোপন করেছিলাম। সেখানে এক বছর পরই গাছে ফল দরে। ১০টি গাছ থেকে তিনি ৩০০টির বেশি ফল পেয়েছেন বলে নয়া শতাব্দীকে জানান। তিনি বলেন, ফল দেখতে অনেক সুন্দর। খেতেও মজা।
রাজশাহী নগরীর বড়বনগ্রাম এলাকার শোভন ইসলাম জানান, আমার তিন তলা বাসার ছাদে ড্রাগনের বাগান করেছি। আমার গাছে ১২ মাস পর ফল ধরেছে। সিমেন্টের খুটি ও টায়ার দিয়ে ড্রাগনের গাছে মাচা করে দিয়েছি। ফল ভালো পাওয়া যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এরকম বহু মানুষ রাজশাহীতে ড্রাগন ফল চাষে উদ্যোগ নিয়েছেন। লাভবানও হচ্ছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কে জে এম আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘ড্রাগন বৃক্ষ একটি ক্যাক্টাস প্রজাতির গাছ। ক্ষরা ও দুর্যোগ মোবাবেলায় সক্ষম। তাই বরেন্দ্র অঞ্চলের রসহীন মাটিতেও চাষের উপযোগী। এজন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিদের ড্রাগন ফলের চাষ করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। এতে রাজশাহী অঞ্চলে ড্রাগন চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান তিনি।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ