ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২২

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নৌকাডুবির ঘটনায় মামলা, আটক ৫

তদন্ত কমিটির কাজ শুরু
প্রকাশনার সময়: ২৮ আগস্ট ২০২১, ২১:৩১ | আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২১, ২১:৪৮

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে লইসকা বিলে যাত্রীবাহী নৌকাডুবির ঘটনায় নাশরা নামে আরো এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার সকাল ১০টায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা লইসকা বিল থেকে ওই শিশুর লাশ উদ্ধার করেন। এনিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২২ জনে দাঁড়িয়েছে। এঘটনায় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।

এদিকে যাত্রীবাহি নৌকাডুবির ঘটনায় ২টি বাল্কহেড(ইঞ্জিন চালিত বালুর নৌকা)সহ ৫জনকে আটক করেছে পুলিশ। এব্যাপারে বিজয়নগর থানায় মামলা রুজু করা হয়েছে। লাশ উদ্ধারের পর নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

নৌকার সঙ্গে বালুবোঝাই ট্রলারের সংঘর্ষের ঘটনায় শনিবার সকালে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত কাজ শুরু করেছে। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল আমীন, সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হোসেন রেজা, ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম। তারা স্থানীয়দের সাথে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। আগামী তিন দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

যারা নিহত হয়েছেন

নিহতরা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চিলোকূট গ্রামের আব্দুল্লাহ মেয়ে তাকওয়া (৮), চম্পকনগর গ্রামের জহিরুল হক ভ’ইয়ার ছেলে মামুন ভূইয়া (২০), গেরারগাঁও গ্রামের মৃত কালু মিয়ার স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৬০), একই গ্রামের জজ মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪০), একই গ্রামের জজ মিয়ার মেয়ে মুন্নি (০৬), গেরারাগাঁর গ্রামের মৃত আব্দুল হাসেমের স্ত্রী কমলা বেগম, নুরপুর গ্রামের মৃত আব্দুল রাজ্জাকের স্ত্রী মিনারা বেগম, আদমপুর গ্রামের অখিল বিশ্বাসের স্ত্রী অঞ্জলী বিশ্বাস (৩০), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার পৈরতলা গ্রামের আবু সাঈদের স্ত্রী মোমেনা বেগম (৫৫), একই উপজেলার সাদেকপুর গ্রামের ফুয়াদ হোসেন ছেলে তানভীর (০৮), নরসিংসার গ্রামের জামাল মিয়ার ছেলে সাজিম (০৭), ভাটপাড়া গ্রামের জারু মিয়ার মেয়ে শারমিন (১৮), উত্তর পৈরতলা গ্রামের ফারুক মিয়ার স্ত্রী কাজলী বেগম, পৌর এলাকার দাতিয়ারা গ্রামের মোবারক মিয়ার মেয়ে তাসফিয়া মীম (১২), ময়মনসিংহ জেলার খোকন মিয়ার স্ত্রী ঝরনা বেগম (৫৫), আদমপুর গ্রামের পরিমল বিশ্বাসের মেয়ে তিথিবা বিশ্বাস (০২), মনিপুর গ্রামের হাজী আব্দুল বারীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৫৮), বাদেহারিয়া গ্রামের কামাল হোসেনের মেয়ে মাইদা আক্তার (০৬), ময়মনসিংহ জেলার গোপালপুর গ্রামের শাওনের মেয়ে সাজিদ (০৩), বড় পুকুরপাড়ের মোঃ সোলায়মান মিয়ার স্ত্রী রুবিনা আক্তার, সোনাবর্ষিপাড়ার আব্দুল বারী ভূইয়া স্ত্রী মোসাঃ নুসরাত জাহান, উত্তর পৈরতলা গ্রামের হারিজ মিয়ার মেয়ে নাফসা আক্তার (০৩)।

মরদেহ শনাক্তের পর হস্তান্তর

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে যাত্রীবোঝাই নৌকার সঙ্গে বালুবোঝাই ট্রলারের সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত ২২জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এদিকে গত শুক্রবার রাতেই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে মরদেহ শনাক্তের পর হস্তান্তর করা শুরু হয়েছে স্বজনদের কাছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন জানান, কিছু মরদেহ ঘটনাস্থলে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালেও বাকি মরদেহ নিয়ে আসা হয়। তাদের স্বজনরা মরদেহ শনাক্ত করার পর হস্তান্তর করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ২০টি লাশ এবং ঘটনাস্থলে ০২টি লাশ স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিনা ময়নাতদন্তে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।

ট্রলারডুবির ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ৫

লইসকা বিলে যাত্রীবাহী নৌকা ডুবির ঘটনায় বিজয়নগর থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। শনিবার দুপুরে বিজয়নগর উপজেলার গেরারগাও গ্রামের আব্দুল হাসিম মিয়ার ছেলে সেলিম মিয়া বাদী হয়ে সাতজনের বিরুদ্ধে বিজয়নগর থানায় মামলাটি করেন। মামলা নং-৪৪। এ ঘটনায় ২টি ইঞ্জিন চালিত বালুর নৌকাসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আসামিরা হলেন-বালুবাহী ট্রলারের মাঝি জেলার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের ষোলাবাড়ি এলাকার জমির মিয়া (৩৩), মো. রাসেল (২২), খোকন মিয়া (২২), মো. সোলায়মান (৬৪) ও বিজয়নগর পত্তন ইউনিয়নের কালারটেক গ্রামের মিস্টু মিয়া (৬৭)। বাকি দুজনের নাম জানায়নি পুলিশ।

দুর্ঘটনায় মামলার বাদী সেলিম মিয়া (৪০) পরিবারে চারজন স্বজন মারা গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোজাম্মেল হোসেন রেজা গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ট্রলারডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরো ২ জনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এছাড়া ২টি বাল্কহেড(ইঞ্জিনচালিত বালুর নৌকা) আটক করা হয়েছে।

নৌকা চলাচল সাময়িক বন্ধ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের লইসকা বিলে নৌকাডুবির ঘটনার পর নৌকা চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিলের পাড়ে স্বজনদের ভিড়ও কমে গেছে। এদিকে শুক্রবার রাত নাগাদ উদ্ধার হওয়া ২১ জনের লাশ শুক্রবার রাতের মধ্যেই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গতকাল শনিবারে উদ্ধার হওয়া শিশুটি লাশ সকালে হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে। এ সময় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শত শত মানুষের ভিড় সামলাতে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়। দুর্ঘটনার কারণে ওই নৌপথে সাময়িকভাবে চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে মনিপুর এলাকায় বালুবাহী ট্রলারের ধাক্কায় প্রায় ৭০ জন যাত্রী নিয়ে চলা নৌকা ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনার সর্বশেষ উদ্ধার হওয়া ওই শিশুসহ মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ২২ এ। এ ঘটনায় নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

তীরের কাছে এসে ডুবে গেল তরী

ট্রলারটিতে সর্বশেষ যাত্রী উঠেছিল মনিপুর ঘাট থেকে। আর মাত্র ১০-১৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই ট্রলারটি পৌঁছে যেত আনন্দবাজার ঘাটে। এটিই ছিল দিনের শেষ খেয়া। কিন্তু তীরের কাছাকাছি এসেও ডুবে গেল তরী। বালুবোঝাই ট্রলারের সঙ্গে সংঘর্ষে ডুবে যায় শতাধিক যাত্রীবোঝাই ট্রলারডুবে মৃত্যু হয় ২২জনের। এছাড়া নিখোঁজ হন অর্ধশত যাত্রী। মর্মান্তিক এ ঘটনাটি শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের লইসকা বিলে ঘটে। যাত্রীবাহি ট্রলারটি বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ঘাট থেকে জেলা শহরের আনন্দবাজার ঘাটের দিকে আসছিল।

ট্রলারডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী আলী আক্তার রেজভী জানান, ট্রলারটি লইসকা বিল আসার পর বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বালুবোঝাই ট্রলারের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে যাত্রীবোঝাই ট্রলারটি ডুবে যায়। কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই পানিতে তলিয়ে যান।

লইসকা বিলে নিখোঁজ বড়ভাইয়ের জন্য আহাজারি করা এনামুল ইসলাম জানান, তার ভাই সিরাজুল ইসলাম মনিপুর ঘাট থেকে ট্রলারটিতে ওঠেন আনন্দবাজারে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুদূর যাওয়া পরই ট্রলারটি ডুবে যায়। এতে তার ভাই নিখোঁজ হন। বিজয়নগর উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের জহিরুল ইসলাম জানান, নববধু শারমিন আক্তারকে নিয়ে ট্রলারে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন তিনি। ট্রলারটি ডুবে যাওয়ার সময় তিনি সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও স্ত্রীকে টেনে তুলতে পারেননি।

শিশু নাশরার চাচা মাসুদ মিয়া জানান, শুক্রবার সকালে নাশরা তার চাচা ফারুক মিয়ার শ্বশুরবাড়ি বিজয়নগর উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে বেড়াতে যায়। বিকালে ট্রলারে করে বাড়ি ফিরছিল তারা। ফারুক ট্রলারের ছাদে এবং নাশরা ও তার চাচি কাজল বেগম ট্রলারের ভেতরে ছিল। ট্রলারডুবিতে আমার ভাবি কাজল বেগম মারা গেছেন। ফারুক সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও নাশরাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, বিলে ট্রলারডুবির ঘটনায় শিশু নাশরা নিখোঁজ ছিল। তাকে অনেক চেষ্টা করে আজ সকালে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় ২২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২২জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ডুবে যাওয়া নৌকাটি উদ্ধার শেষে শনিবার বিকালে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খাঁন জানান, নিহতদের প্রত্যেকের দাফনের জন্য পরিবারের কাছে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।

নয়া শতাব্দী/এসইউ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ