কক্সবাজার পৌরসভার সামনে দেয়ালঘেঁষে গড়ে উঠেছে সোনালী ফটোস্ট্যাট নামের একটি দোকান। সাইনবোর্ড দেখে বাইরে থেকে মনে হবে কম্পিউটার-ফটোকপির দোকান। কিন্তু ভেতরে প্রকাশ্যে চলছে পাসপোর্ট দালালদের কারবার। ভুয়া সিল ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে যাবতীয় নকল কাগজপত্র। হাত বাড়ালেই মিলছে সব। ডিসি অফিস এবং পৌরসভার সামনে এই দোকান ঘিরেই তৎপর পাসপোর্ট দালাল চক্রের সদস্যরা।
এদের একজন সাহাব উদ্দিন জনি। সাহাব উদ্দিন সরকার দলীয় সহযোগী সংগঠন আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের কক্সবাজার পৌরসভার সাধারণ সম্পাদক। পাসপোর্ট অফিসে দালালি করে প্রভাবশালী এই নেতা এতদিন ধরাকে সরাজ্ঞান করে দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতার অপব্যবহারের ছড়ি ঘুরিয়েছেন। এক সময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নিজেকে সরকারি দলপন্থী নেতা জাহির করে দু’হাতে হাতিয়ে নিয়েছেন দালালি-কমিশনের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। রোহিঙ্গাদের ভোটারও করেছেন পর্দার আড়ালে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের চিহ্নিত পাসপোর্ট দালাল সাহাব উদ্দিন এখন সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের নাম বেচে বহুমুখী অপকর্ম করে যাচ্ছেন। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শূন্য হাতে কক্সবাজার শহরে আসলেও এখন তিনি কোটিপতি। নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়িও।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয়দের পাশাপাশি সাহাব উদ্দিন অসংখ্য রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট এবং ভোটার করতে সহযোগিতা করেছেন। এভাবে আয় করেছেন কোটি টাকা। সেই টাকা খরচ করে এখন তিনি সরকারি দল মৎস্যজীবী লীগের জেলার শীর্ষ পদ ভাগিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
সাহাব উদ্দিনের বাড়ি রামু উপজেলার গর্জনিয়ায়। অভিযোগ আছে, হাইস্কুল জীবন থেকেই সে শিবিরের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিয়মিত উপস্থিতি থাকত। এমনকি গ্রামের সহজ সরল কিশোরদের আবুল আলা মওদুদী ও জামাত সম্পর্কিত বিভিন্ন বইপুস্তক বিলি করত।
কক্সবাজার শহরে আসার পর বোল পাল্টে সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও ভোটার করার মাধ্যমে অপরাধ জগতে হাতেখড়ি হয় তার। এরপর থেকে সরকারি দলের সহযোগী সংগঠন আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের নেতা পরিচয়ে নানা কর্মসূচিতে পা রাখতে শুরু করেন।
দশ বছরের ব্যবধানে তার জীবনযাপনের চিত্র অস্বাভাবিক মাত্রায় পাল্টে গেছে। কক্সবাজার শহরের অভ্যন্তরে বিলাসী জীবনের স্বাদ ভোগ করা ছাড়াও নানাভাবে গ্রামেও বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে গেছেন। শিবিরের রাজনীতির সাথে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে তার কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
সরকারের সহযোগী সংগঠনটির নেতাকর্মীদের দাবি, সাহাবউদ্দিন শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি জেনেও কয়েকজন নেতা মাসোয়ারা ভিত্তিক তাকে সংগঠনটিতে স্থান দেন। তাদের মতে, বিপুল টাকার বিনিময়ে সংগঠনটির পৌর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদটিও ভাগিয়ে নিয়েছেন তিনি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সাহাব উদ্দিনের এক সময়ে কিছুই ছিল না। আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের পৌর কমিটির পদ পাওয়ার পর তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। এখন সে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও দালাল চক্রের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এ সিন্ডিকেটকে ব্যবহার করে বর্তমানে সে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা জানান, একসময় পাসপোর্টের দালালি করলেও মৎস্যজীবী লীগের পদটি পাওয়ার পর থেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসংখ্য রোহিঙ্গাদের ভোটার করেছেন। এছাড়াও একদিকে আইনজীবী সহকারী অন্যদিকে ভোটার নিবন্ধন সম্পর্কিত নানা স্পর্শকাতর সমস্যার সমাধান দিতে তিনি ঠিকাদার হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। চক্র গড়ে তুলেন পাসপোর্ট অফিসের কথিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ও মেম্বারদের সঙ্গে। এরাই মূলত তাকে জন্মনিবন্ধনের জন্য সুপারিশ দেন।
শুধু তাই নয়, সাহাব উদ্দিন ইয়াবা ও হত্যা মামলার আসামিদের দ্রুত জামিন করিয়ে দেয়ার নামেও সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এইসব প্রতারণার অভিযোগে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কয়েকবার আটক হয়ে কারাভোগও করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাহাব উদ্দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠার পেছনে সরকার দলীয় কয়েকজন নেতার ভূমিকা রয়েছে। তাদের প্রশ্রয়ে তিনি বহুমাত্রিক অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এছাড়াও সমাজের হতদরিদ্র নারীদের চাকরি দেয়ার ফাঁদে ফেলে তাকে রক্ষাকারী সেই নেতাদের বেডরুমে যেতে বাধ্য করেন। পরে এইসব নারীরা সম্ভ্রম হারালেও লজ্জায় প্রতিবাদ করে না। তবে অনেকবার বিপদেও পড়েছেন। ভুক্তভোগী একাধিক নারীর হাতে কক্সবাজার আদালত পাড়ায় লাঞ্চিত হলে পরে নগদ টাকায়তাদের সাথে মীমাংসা করতে বাধ্য হয়েছেন।
জানা গেছে, এসব অপরাধের বেইজক্যাম্প কোর্ট বিল্ডিংস্থ সোনালী ফটোস্ট্যাট। সেখানেই একটি চেয়ারে বসে চক্রের অন্য সদস্যদের নিয়ে এসব অপরাধের বিস্তার ঘটায় সে। সোনালী ফটোস্ট্যাটের অপরাধের ভাগাড়ে বসে বিপুল অর্থ উপার্জনের ফলে আরও কয়েকটি বেইজক্যাম্প বসান সাহাব উদ্দিন।
গর্জনিয়া গ্রামের ছনের ঘরটি করেছে সেমিপাকা করেছেন। সম্প্রতি সেখানে তার কয়েকটি রাবার বাগানের প্লট ও মৎস্যঘের ক্রয় করেছেন। গর্জনিয়া বাজারে ভাড়ায় চালান ৩ টি দোকান। তার অনুপস্থিতিতে ভাইপো-ভাগ্নেরা এসব দেখভাল করেন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শহরের বাড়িতে পাসপোর্ট অফিস, ইউনিয়ন পরিষদের জন্মনিবন্ধন ও পরিচয় পত্রের নকল কপি রয়েছে। এসব অফিসের কর্মকর্তাদের সিল থেকে শুরু করে প্যাড এবং অলিখিত সনদ ব্যবহার করেন।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও অভিযুক্ত সাহাব উদ্দিন কথা বলতে রাজি হননি। বরং প্রতিবেদকের পরিচয় নিশ্চিত হলে রং নাম্বার উল্লেখ করে ফোনের লাইন কেটে দেন।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ