প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থান করছেন কক্সবাজার সদরের পিএমখালী এলাকার কামাল হোসেন (ছদ্মনাম)। কাজ করছেন একটি দোকানে। মাসে বেতন পান আড়াই হাজার রিয়াল। ওভার টাইম আছে। ফলে সব খরচ বাদে মাসে দুই হাজার রিয়ালের মতো থাকে। যার সিংহভাগ পাঠান দেশে।
কীভাবে এ অর্থ দেশে পাঠান-ফেসবুক মেসেঞ্জারে জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। বলেন, কয়েকটা মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাই। এখানকার ব্যাংক থেকে দেশের ব্যাংকে অথবা বিকাশের মাধ্যমে। তবে, সহজ হয় হুন্ডিতে (নিষিদ্ধ অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থা) পাঠালে।
কামাল বলেন, প্রথমে ব্যাংকেই পাঠাতাম। রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে ফরম পূরণ করতে হয়, অনেক সময় কাগজপত্রও দিতে হতো। এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগতো। ওদের কথাও বুঝা যেত না। একদিন রেমিট্যান্স পাঠাতে গিয়ে অনেক সময় চলে যায়। ফলে ওই দিন আর কাজে যেতে পারিনি। পরে এক বন্ধু জানাল, ঝামেলার দরকার কী, হুন্ডিতে পাঠাও। তার কথা মতো পরের মাসে হুন্ডি করলাম। সঙ্গে সঙ্গে দেশে টাকা চলে গেল। রেটও ব্যাংকের চেয়ে বেশি পেলাম। এরপর থেকে হুন্ডিতে টাকা পাঠাই। মাঝে মাঝে ব্যাংকেও পাঠাই।
কামালসহ একাধিক প্রবাসী জানান, কক্সবাজার সদরের পিএমখালীর ডিকপাড়া এলাকার নজীব সওদাগরের ৬ ছেলের মধ্যে নবাব মিয়া, মোর্শেদ, মিজান সৌদিতে থাকেন। তাদের নিয়ন্ত্রনে থাকা একটি হুন্ডি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মক্কায় থাকা অধিকাংশ প্রবাসী দেশে টাকা পাঠান। বাংলাদেশে থাকা অপরাপর তিন ভাই বেদার, খোরশেদ ও সাকিবসহ তাদের বেতনভুক্ত একাধিক যুবক বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ওই টাকা সাপ্লাই দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রবাসী বলেন, দেশে টাকা পাঠানোর দরকার পড়লে মক্কায় থাকা নবাব মিয়াকে ফোন দিলে তিনি তার কারে করে এসে টাকা নিয়ে যায়। বাংলাদেশে থাকা তার ভাইদের মাধ্যমে বাড়িতে পৌঁছে দেন। দেশ থেকে নিতে হলেও নবাব মিয়ার ভাই বেদার, সাকিব খোরশেদের হাতে দিলে সৌদিতে নবাব ওই টাকা বুঝিয়ে দেন। এভাবে করে আমরা টাকা আদান প্রদান করে থাকি।
এভাবেই তারা শূণ্য থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। নামে-বেনামে ক্রয় করেছেন বহু জায়গা-জমি। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করেছেন আলিশান বাড়ি। গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে কোটি কোটি টাকা তারা সহজেই পাচার করছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।স্থানীয় সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী পিএমখালীতে চিহ্নিত হুন্ডি চক্র আছে ১০টির বেশি। এইসব হুন্ডি ব্যবসায়ীদের নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্ব।
এই কথার সূত্র ধরে প্রতিবেদকের পরিচয় গোপন রেখে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় বাংলাদেশ থেকে তিন লাখ টাকা সৌদি আরবের মক্কায় থাকা এক প্রবাসীর কাছে পাঠাতে চেয়ে বেদারকে কল দেওয়া হয়।
বেদার বলেন, আপনার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা গ্রহণের জন্য সৌদি থেকে কোন ম্যাসেজ এখন পর্যন্ত আসেনি তাই টাকাগুলো এখন গ্রহণ করা যাবে না। আমি আগে সেখানে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হই; তারপর টাকা নিয়ে কোথায় আসবেন আপনাকে ঠিকানা দেবো।
কিছুক্ষণ পর বেদার ফোন দিয়ে জানান, সৌদিতে থাকা তার ভাইকে কেউ একজন টাকা পাঠানোর কথা বলেছিলেন তা এখন মনে পড়ছে না। তিনি ওই প্রবাসীকে তার ভাই নবাব মিয়াকে ফোন দিতে অথবা প্রবাসীর নাম্বার তাকে দিতে বলেন। কথা বলার পর দর-দাম জানানো হবে বলে তিনি জানান। ওই কথোপকথনের কল রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
পরে সাংবাদিক পরিচয় পেলে হুন্ডির বিষয়টি স্বীকার করে বেদার বলেন, আমরা আগে হুন্ডি ব্যবসা করতাম। এখন ছেড়ে দিয়েছি। লেনদেনের কথোপকথনের বিষয়টি দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে বেদার কোন সদোত্তর দিতে পারেন নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা জুড়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে হুন্ডি ব্যবসা। পিএমখালী থেকে প্রতিদিন ৪ থেকে ১০কোটি, মাসে প্রায় তিনশ কোটি টাকা অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সদরের কয়েকটি পয়েন্ট জুড়ে চলছে এই অবৈধ ও বেআইনী তৎপরতা। হুন্ডি কারবারীদের ট্রানজিট রুটে পরিণত হয়েছে পিএমখালী। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন সংস্থার সদস্য ও কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকও এই অবৈধকাজে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে হুন্ডি কারবারি চক্রের একাধিক সিন্ডিকেটের নাম। তার মধ্যে ডিকপাড়া এলাকার বেদার ও তার অপরাপর দুই ভাই খোরশেদ, সাকিব। তারাই পিএমখালী থেকে পুরো জেলা নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের নেটওয়ার্ক দেশের অভ্যন্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে বেআইনী আগ্নেয়াস্ত্র, মাদকদ্রব্য, স্বর্ণ চোরাচালান ও নারী শিশু পাচারকারী চোরাকারবারিদের। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষ পাচার ও সমুদ্রপথে অবৈধভাবে লোক পাঠানোর সঙ্গেও হুন্ডি সিন্ডিকেটের বড় ধরনের দহরম-মহরম রয়েছে।
এই সিন্ডিকেট প্রায় প্রতি জেলার একাধিক গ্রামে কমিশনভিত্তিক এজেন্ট নিয়োগ করে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার নামে নানান ধরনের প্যাকেজ দিয়ে প্রলুব্ধ করছে। ইদানিংকালে বিভিন্ন ব্যবসার নামের আড়ালে মানুষ পাচারের কাজ করছে। পাশাপাশি মাদকদ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্রের চাহিদা জানানোর পর তার দাম পরিশোধ করা হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে।
সৌদি আরব এবং দোবাইয়ের জাল রিয়াল, দিরহাম তুলে দিচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছোট ছোট প্রান্তিক চোরাকারবারিদের হাতে। এ ছাড়াও বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিকারী একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে এই চক্রের মাধ্যমে। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
স্থানীয়রা বলছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যরা শুধু ইয়াবা কারবারিদের নিশানা করলেও নিরাপদেই রয়ে গেছে এইসব হুন্ডি সিন্ডিকেট। সে কারণে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বেশ কয়েকজন ইয়াবা কারবারি নিহত হলেও পাচার বন্ধ হচ্ছে না। কারণ ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে হুন্ডি সিন্ডিকেটের সদস্যদের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। ইয়াবা কারবার চলে হুন্ডির মাধ্যমেই।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বেদার, খোরশেদ, সাকিবসহ ১৫ থেকে ২০ জনের একটি সক্রিয় ‘হুন্ডি সিন্ডিকেট’ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, দুবাই, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের হুন্ডি কারবারিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পাচার করা ইয়াবার চালানের লেনদেন হয়ে থাকে হুন্ডির মাধ্যমেই। তাই শীর্ষস্থানীয় ইয়াবা কারবারিদের অনেকেই এই হুন্ডি সিন্ডিকেটও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আন্তর্জাতিক হুন্ডি সিন্ডিকেটের অফিস রয়েছে সৌদি আরবে। মক্কা হয়ে হুন্ডির লেনদেন হয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার শহর, পিএমখালীর চেরাংঘর, ডিকপাড়া নজিব সওদাগরের বাড়িতে গোপনে হুন্ডির টাকা হাতবদল হলেও বর্তমানে তা ওপেনসিক্রেট। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হুন্ডিকারবারি চক্রের এজেন্টরা সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন এলাকার প্রবাসীদের বাড়ি বাড়ি চলে যাচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো সতর্ক অবস্থানে চলে যাওয়ার কারণে এবং টিটি ডিডি করতে গেলেই নানান ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এমনকি অন লাইনে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনে জিজ্ঞাসাবাদ ও পৃথক ঠিকানা নথিভুক্ত করায় হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ব্যাংক এড়িয়ে চলছে। তারা সরাসরি অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তদের যোগসাজশে নগদ টাকা সংগ্রহ করে মোটরসাইকেল, মাইক্রো বা নাইট কোচে বহন করছে। একইভাবে কক্সবাজার শহরের বিকাশ এজেন্টরা এখন বৈধ ব্যবসার আড়ালে হুন্ডি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোপূর্বে হুন্ডি সিন্ডিকেট ও হুন্ডি চোরাকারবারিরা ব্যাপক হারে বাণিজ্যিক ব্যাংক টাকা লেনদেনে ব্যবহার হয়ে থাকত সেই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে সমগ্র পিএমখালীর ২০ থেকে ২৫ জনকে চিহ্নিত করে।
তার মধ্যে পিএমখালীর মাশি, নুর করিব, নুরুল আমিন, সাদেকুল ইসলাম ছোটনকে বড় মাপের চোরাকারবারি হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। একই সঙ্গে তাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও শনাক্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। অবৈধ হুন্ডির স্রোত এতটাই তীব্র ছিল যে, বেশ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা তাদের ব্যাংকিং কর্মকান্ড- বাসাবাড়িতে পরিচালিত করত। সারারাত ধরে চলত টাকা গণনার কাজ। কারণ এসব টাকা রাত্রেই বেশি আসে। মাশি দীর্ঘদিন জেল খাটলেও বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। পরবর্তীতে কী এক রহস্যজনক কারণে ডিটেক্ট করা হুন্ডি চোরাকারবারি ও তাদের দোসর ব্যাংক কর্মকর্তাদের কোন ধরনের আইনের আওতায় না এনে সরে আসে কর্তৃপক্ষ।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, হুন্ডির বিষয়টি আগে কেউ অবগত করেনি। তাদের তথ্য সংগ্রহ করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ