পাখি দত্ত (৩০)। তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষ। সমাজে যারা হিজড়া নামে পরিচিত। সাফল্য সিঁড়ি বেয়ে তিনি এখন পথ দেখাচ্ছেন সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে।
এ প্রতিবেদককে তার হার না মানা জীবনের গল্প ও স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন।
গত ৯ ডিসেম্বর মহিলা অধিদফতর আয়োজিত অনুষ্ঠানে পাখির হাতে জয়ীতা পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। সমাজ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সফলতায় তিনি এ পুরস্কারে মনোনীত হন। এ অনুষ্ঠানে সাতজন জয়ীতাকে পুরস্কৃত করা হয়।
পাখি দত্ত বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে গেজেট দিয়েছেন তাতে হিজড়া সম্প্রদায় হিসেবে তাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। যে কারণে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে তিনি কষ্ট পান।
পাখি হিজড়া খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা সাত্তার মিয়া সড়কে বাস করেন। বাবা হারা এই পাখি হিজড়া মা রিনারাণী দত্তের প্রেরণায় আজ তিনি এ সম্প্রদায়কে নিয়ে এতদূর আসতে পেরেছেন। ছোট বোন উপমা দত্ত চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। হিজড়া হয়েও পাখি দত্ত পরিবারের হাল ধরেছেন।
২০০৫ সাল থেকে তিনি হিজড়াদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে গড়ে ওঠা জাতীয় সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাথে যুক্ত হন সুবিধাভোগী হিসেবে। ২০১৭ সালে বন্ধুর পরিবারের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। যা ২০২০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ২০১৮ সালের শেষের দিকে নিজ উদ্যোগে তিনি গড়ে তোলেন নক্ষত্র মানব কল্যাণ সংস্থা। বর্তমানে তিনি বন্ধুর ইএলএমসি প্রকল্পের ভলেন্টিয়ার হিসেবে যুক্ত আছেন।
পাখি দত্তের অনুভূতি কি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুরস্কার পেতে সবার ভালো লাগে। এ পুরস্কার আমাকে অনুপ্রেরণা যোগাবে অবহেলিত এ জনগোষ্ঠীর সহযোগিতা করতে। আমি মায়ের অনুপ্রেরণায় এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আমাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন বিভাগীয় গুরুমা পান্না হিজড়া ও গুরুমা শিল্পী হিজড়া। সফলতার পেছনে এদের নাম না বললে আমার অনুশোচনা থেকেই যায়। একই সাথে আমার সংগঠন নক্ষত্র মানব কল্যাণ সোসাইটির সদস্যদের কাছে কৃতজ্ঞ। সদস্যদের মধ্যে রয়েছে সজল আহমেদ, ইসতিয়াক মাহমুদ, আল আমিন শরীফ, শহিদুল ইসলাম সুমন, মো. রানা, সুদেব মণ্ডল উল্লেখযোগ্য।
সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন তার নিজস্ব একটি বেসরকারি, অরাজনৈতিক ও অলাভজনক, সমাজকল্যাণমূলক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে, ‘নক্ষত্র মানব কল্যাণ সংস্থা’ নামে। সংগঠনটি সমাজের পিছিয়ে পড়া যুব নারী-পুরুষ, পথশিশু, হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যয় জনগোষ্ঠীসহ সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে এনে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে আসছে। ‘পাখি দত্ত’ একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হয়েও সমাজসেবা ও মানবতার কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
আগামীর পরিকল্পনা সম্পর্কে পাখি দত্ত বলেন, সমাজসেবার পাশাপাশি আমার একটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে, বিশেষ করে হিজড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা রয়েছেন তারা কোথাও তাদের লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ পান না, তাই ভবিষ্যতে একটি সুপারশপ তৈরি করার ইচ্ছা, যাতে করে হিজড়া/ লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীসহ সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। আমাদের এই ক্ষুদ্র মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেশ বিদেশে আপনাদের সকলের সহযোগিতা পরামর্শ সহায়ক শক্তি। ‘নক্ষত্র মানব কল্যাণ সংস্থা’র পক্ষ থেকে আপনাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সংস্থা’র সাথে সম্পৃক্ত থাকায় আপনাদের সবাইকে বিশেষ ধন্যবাদ দেশের হত দরিদ্র অসহায় মানুযের জন্য আমরা আমাদের এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখবো।
যে সংস্থার বিচারে পাখি দত্ত জয়ীতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন সেই সংস্থার নাম হলো খুলনা মহিলা বিষয়ক অধিদফতর। ওই অধিদফতরের উপ-পরিচালক হাসনা হেনা বলেন, সমাজ উন্নয়ন ক্ষেত্রে পাখি দত্তের অবদান রয়েছে। সেই অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি খুলনা জেলায় জয়ীতা নির্বাচিত হন। পিছিয়ে পড়া হিজড়া জনগোষ্টীকে পাখি দত্ত সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করে চলেছেন। যেটা সমাজের জন্য খুবই ইতিবাচক। বাজার থেকে চাঁদা কালেনশন করা, বাচ্চা নাচানোসহ নানা ধরনের চিরাচরিত কর্মকাণ্ডের বাইরে এসে পাখি দত্ত সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছেন। তার কর্মকাণ্ড সমাজে হিজড়া সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণা পাল্টে দিতে সহায়তা করবে। সমাজ তাদের গ্রহণ করতে উৎসাহিত হবে। তৃতীয় লিঙ্গের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নে পাখি দত্তের চলমান কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকুত এই কামনা করেন তিনি।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ