বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে ভ্রমণের ভরা মৌসুম চলছে এখন। কিন্তু কাঙ্খিত পর্যটকের দেখা মিলছে না। করোনা মহামারি শুরুর আগের বছর গুলোতে এই সময় প্রতিদিন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখোরিত ছিল সুন্দরবন।
পর্যটনের ভরা মৌসুমে পূর্ব সুন্দরবনে এবার পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে। পর্যটকদের জন্য বন বিভাগের অতিরিক্ত হারে ভ্রমণকর নির্ধারণ ও জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটকরা সুন্দরবনে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়েছে। কাঙ্ক্ষিত পর্যটক না পাওয়ায় পর্যটনের সঙ্গে জড়িত বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার সময় পার করছেন বলে ট্যুর অপারেটররা জানিয়েছেন।
সেই হিসেবে এবছর সুন্দরবনে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এমনকি বহুল পরিচিত স্পটগুলোতেও পর্যটকদের তেমন দেখা মিলছে না। পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিবর্তে কমে যাওয়ায় সুন্দরবন ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে জড়িতরা হতাশায় ভুগছে। পর্যটকের সংখ্যা কেন হৃাস পেয়েছে তার সঠিক কারণ কেউ বলতে পারছে না।
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন কেন্দ্রে পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষনীয় স্থান। সুন্দরবনে ভ্রমণে আসা অধিকাংশ পর্যটক করমজলে আসেন। করোনার আগের বছর গুলোতে এই সময়ে প্রতিদিন করমজলে কয়েকশত পর্যটকের দেখা মিলেছে। সেই করমজলে মাত্র ২০ জন পর্যটককে ঘুরতে দেখা গেছে। অনেকটাই ফাঁকা ছিল করমজল।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন। সুন্দরবনের অপরূপ দৃশ্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এর মধ্যে বিশেষ করে সুন্দরবনের করমজল, হারবারিয়া, কলাগাছিয়া, কটকা, কচিখালী, দোবেকী এবং হিরোনপয়েন্ট এলাকা পর্যটকরা ভ্রমণ করে থাকেন।
করমজল, হারবারিয়া ও কলাগাছিয়া এই তিনটি স্থানে পর্যটকরা ভ্রমণে গিয়ে দিনের মধ্যেই ফিরে আসেন। এ কারণে ওই তিনটি স্থানে প্রবেশ করার পর পর্যটকরা প্রবেশ ফি দিয়ে থাকেন।
অপর চারটি স্থানে ভ্রমণ করতে হলে আগে থেকে বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পর্যটকদের সুন্দরবনে আসতে হয়।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির জানান, সুন্দরবন ভ্রমণের এখন ভরা মৌসুম চলছে। এই মুহুত্বে করমজলে পর্যটকদের পদচারনায় মুখোরিত থাকার কথা। কিন্তু সেই হিসেবে পর্যটক নেই বললেই চলে। করোনামহামারির আগের বছর গুলোতে ডিসেম্বর মাসের এই সময়ে প্রতিদিন করমজলে প্রায় ৫০০ জন পর্যটকের দেখা মিলেছে।
কিন্তু করমজলে মাত্র ১৯০ জন পর্যটক ভ্রমণ করেছেন। এই মুহূর্তে প্রতিদিন সুন্দরবন ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সংখ্য বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। সেখানে সংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে কেন কম হচ্ছে, তার কারণ বলতে পারছে না ওই বন কর্মকর্তা।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সুন্দরবনে সারা বছর জুড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করে থাকেন। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সুন্দরবন ভ্রমণের ভরা মৌসুম। বনের বিভিন্ন এলাকায় ছোটবড় নানা আকারের নৌযান নিয়ে পর্যটকরা ভ্রমণ করছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে তাদের সব ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে।
আগামীতে সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এমন প্রত্যাশার কথা জানালেন ডিএফও।
ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আযম ডেভিড জানান, করোনার আগে তারা নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করিয়েছে। সেই হিসেবে এবছর নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পর্যটকের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তাদের নৌযানে বুকিংও অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেক নৌযানে বুকিং হচ্ছে না। তাদের এসোসিয়েশনের অধিনে বিভিন্ন আকারের ৬০টি নৌযান রয়েছে। বুকিং কম হওয়ায় ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায় রয়েছে।
সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আযম ডেভিডের তথ্যমতে, সুন্দরবনে তিনদিন দুই রাত ভ্রমণের জন্য তাদের তিন ধরণের প্যাকেজ রয়েছে। ইকনোমিক প্যাকেজের জন্য জনপ্রতি খরচ সাত হাজার টাকা, ডিলাক্স প্যাকেজের জন্য জনপ্রতি ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার এবং বিলাসবহুল প্যাকেজের জন্য জনপ্রতি ১৫ থেকে ২২ হাজার টাকা নিয়ে থাকে।
সব কিছুর মূল্যের বৃদ্ধির কারণে তারাও প্যাকেজ প্রতি এক থেকে তিন হাজার টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া ২৩ ডিসেম্বর তার ছোটবড় দু’টি নৌযানে ৪০ জন পর্যটকরে বুকিং রয়েছে।
সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আযম ডেভিড জানান, প্যাকেজের মূল্যবৃদ্ধি, বন বিভাগের ফি বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি এবং সেই অর্থে মানুষের আয় বৃদ্ধি না পাওয়ায় সুন্দরবনে পর্যটক কম আসছে।
দু’টি জালি বোর্টের মালিক মো. ইলিয়াস হোসেন করমজল থেকে জানান, সে প্রায় ২০ বছর ধরে মোংলা থেকে তার জালি বোটে করে পর্যটকদের নিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করিয়ে আসছে। পর্যটকদের ভ্রমণ করিয়ে তার সংসার চলে। প্রায় দুই মাস ধরে পর্যটক নেই বললেই চলে। ২০ থেকে ২৫ জনের ধারণ ক্ষমতা সম্পূর্ণ তার জালি বোটে মাত্র চারজন পর্যটককে নিয়ে সে করমজলে এসেছে। পর্যটক কম আসায় তার সংসারের খরচ মিটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
যশোর থেকে করমজল ভ্রমণে আসা সেনা সদস্য মো. ইমাম উদ্দিন জানান, পরিবারের সদস্য মিলে তারা আটজন সুন্দরবন ভ্রমণে এসেছে। করমজল এসে ঘুরে দেখে তাদের অনেক ভাল লেগেছে।
বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সুন্দরবনে ৭৫ হাজার ৫৬০ জন দেশি এবং ৮৬৪ জন বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেছেন। ওই অর্থ বছর সুন্দরবন বিভাগ পর্যটকদের কাছ থেকে ৮৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭০ টাকা রাজস্ব আয় করে। আর চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ২০ হাজার ১৮ জন দেশি এবং ২৫৩ জন বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছে। এসব পর্যটকদের কাছ থেকে ২২ লাখ ৬৪ হাজার ২২৫ টাকা রাজস্ব আয় হয়। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ছয় হাজার ৩৬৬ জন দেশি এবং ৩৭ জন বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করে। আর এবছর নভেম্বর মাসে ৯ হাজার ৮৮৩ জন দেশি এবং ১৫২ জন বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছে।
তবে করোনামহামারির কারণে ওই অর্থবছর সুন্দরবনে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে পর্যটকদের ভ্রমণে আসা বন্ধ ছিল। বন বিভাগ জানায়, সোমবার সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ছোটবড় বিভিন্ন সাইজের ৯টি নৌযানসহ ৪৫৬ জন পর্যটক অবস্থান করছিল।
এছাড়া মঙ্গলবার এবং বুধবার সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য পাঁচটি নৌযান এবং ১৮৮ জনের অনুমতি রয়েছে বলে বন বিভাগ জানায়। সূত্র : ইউএনবি নিউজ
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ