সমুদ্রের ঢেউ এসে চুমু খাচ্ছে বেলাভূমিতে। আর প্রখর রোদে নারী-পুরুষকে আহ্বান জানাচ্ছে শীতল স্নান করার। সেই আহ্বান উপেক্ষা করে এমন সাধ্যি কার! তাই তিন দিনের ছুটির কয়েক লাখ পর্যটকে মুখরিত কক্সবাজারের সাগরতীর। সাগরের নোনাজলে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা ভ্রমণপিপাসুরা।
পর্যটক বাড়ায় খুশি পর্যটন ব্যবসায়ী, সৈকতের ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার, ওয়াটার-বিচ বাইক চালক, বেলাভূমির ঘোড়াওয়ালা আর খুচরো ব্যবসায়ীরাও। বালিয়াড়ি আর ঢেউয়ে চলছে টানা ছুটি উদযাপনের উৎসব। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষের পদচারণায় মুখরিত এখন কক্সবাজার। সাগরতীরে বসেছে ছুটির মিলনমেলা। সবাই মেতেছে উৎসবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারে এখন দুই লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। শহরের রাস্তা অলিগলিতে মানুষ আর মানুষ। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ছাড়াও পাথুরে বিচ ইনানী, পাটুয়ারটেক, সেন্টমার্টিন, রামু, মহেশখালীসহ জেলার অন্যান্য পর্যটন স্পটগুলোও পর্যটকদের পদভারে মুখরিত।
জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের কলাতলী, লাবণী পয়েন্ট, সুগন্ধা এলাকার হোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজে অন্তত ১০০ শতাংশ কক্ষে এখন পর্যটকরা অবস্থান করছেন। ২২ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা তিন দিন পর্যটকে ভরপুর থাকবে হোটেল-গেস্ট হাউসগুলো। বিশেষ করে শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত কক্সবাজারের অধিকাংশ হোটেলে কোনো রুম নেই। বুকিং থাকায় যেসব পর্যটক একদিন আগে কক্সবাজার পৌঁছেছেন, তারা রুম পেতে হিমশিম খাচ্ছেন।
সিলেট থেকে আসা পর্যটক রবিউল ইসলাম জানান, শনিবার সকালে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে তিনি টেকনাফ যাবেন। সেখানকার মিয়ানমার সীমান্ত, ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনির মাথিনকূপ, নাফ নদের বুকে জেগে ওঠা জালিয়ারদিয়া, ন্যাচার পার্ক দেখে টেকনাফ থেকেই রাতের বাসে ঢাকায় ফিরবেন।
কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে সৈকতে এসেছেন সেলিম মোল্লা বলেন, ‘কক্সবাজার পৌঁছে রুম বুকিং করব এমন পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু হোটেল-মোটেলগুলোয় ভালো কোনো রুম পাইনি। কোনোমতে দুই দিনের জন্য একটি হোটেলে রুম নিয়েছি।’
ঢাকার মিরপুর থেকে আসা সৈকত আলী বলেন, ‘টানা ছুটিতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাগে সমুদ্র সৈকতে। তাই কক্সবাজারে তিন দিনের জন্য ছুটে এলাম। আজ সৈকতে গোসল ও ঘোরাফেরা করব পরিবার নিয়ে। আর কাল মেরিন ড্রাইভ ও পাটুয়ারটেক যাব।’
সৈকতের ফটোগ্রাফার আমির রাহাদ বলেন, ‘গত দুদিন খুবই মন খারাপ ছিল। কারণ এই দুদিনে ৫০০ টাকাও আয় হয়নি। তবে আজ প্রচুর পর্যটক এসেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পর্যটকদের ছবি তুলে ২ হাজার টাকা আয় করেছি।’
জেডস্কিচালক মুরশেদ বলেন, ‘পর্যটক এলেই আমরা খুশি হই। এখন লাখো পর্যটক সৈকতে। এতে আমাদের ব্যবসাও ভালো হচ্ছে।’
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) সভাপতি আনোয়ার কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিন দিনের ছুটিতে আমাদের ৪৫০টি হোটেল বুকিং হয়েছে। অনলাইনে অনেক পর্যটক রুম চাইলেও দিতে পারছি না। ছুটির দিনগুলোয় নগরীতে সাড়ে ৩ লাখের বেশি পর্যটক সমাগম হবে।’
পর্যটকদের দায়িত্বে থাকা লাইফ গার্ড কর্মীরা জানান, বৃহস্পতিবার থেকে সৈকতে পর্যটকের চাপ বেশি। তাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা পর্যটকের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে পর্যটন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ হোটেল পর্যটকের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। কক্ষ পেতে ব্যাগপত্র নিয়ে এক হোটেল থেকে অন্য হোটেলে ছোটাছুটি করতেও দেখা গেছে। অন্যদিকে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে দেখা গেছে, হাজারো পর্যটকের ভিড়। কেউ বালিয়াড়িতে দৌঁড়ঝাপ, কেউ সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত সময় পার করছেন। যে যার মতো করে আনন্দে মেতেছেন পর্যটকরা।
আর তাদের ভ্রমণ ও আনন্দ নিরাপদ করতে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে টুরিস্ট পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট। শুধু কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত নয়, পর্যটকরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, পাথুরে সৈকত ইনানী, হিমছড়ি ও রামু বৌদ্ধ মন্দির, মহেশখালী আদিনাথ মন্দিরেও।
কক্সবাজার বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্যসচিব ও পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক রায়হান উদ্দিন বলেন, ‘কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের বাড়তি বিনোদনের জন্য চিন্তাভাবনা চলছে।’
হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি সংগঠনের সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার জানান, সকাল ১০টার পর থেকে সমুদ্রসৈকতে নামতে শুরু করে দর্শনার্থীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্ট দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখর হয়ে উঠেছে। বিকেলের দিকে এই ভিড় আরও বেড়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের এসপি জিল্লুর রহমান বলেন,‘টানা তিন দিনের ছুটিতে কয়েকলাখ পর্যটকের সমাগম হতে পারে। তাই আমাদের ট্যুরিস্ট পুলিশের একাধিক টিমও কাজ করছে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় আমরা সবসময়ই সজাগ আছি।’
তিনি আরোও বলেন, ‘কোনো পর্যটক যেন এখানে এসে হয়রানির শিকার না হয়, ভ্রমণের ভালো স্মৃতি নিয়ে যেন ফিরতে পারে, সেই ব্যবস্থা আমরা করেছি।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটক সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা পর্যটকদের নিরাপত্তায় সবসময় মাঠে আছি। খাবার থেকে শুরু করে সবকিছু দাম নিয়ন্ত্রণ করতে কাজ করে যাচ্ছি। সুতরাং কক্সবাজার এসে কোন পর্যটক আশাকরি হয়রানী কিংবা ভোগান্তির শিকার হবে না।’
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ