এ সময়ের অস্তিত্ব সংকটে পড়া নদীতে প্রাণের ছোঁয়া লেগেছে। মাইলের পর মাইলজুড়ে সবুজের সমারোহ। পরিকল্পিত চাষাবাদের কারণে কক্সবাজারের প্রাণখ্যাত বাঁকখালী নদীর তীরে শীতকালীন সবজি আবাদে বিপ্লব ঘটেছে। বিভিন্ন সময় যে ভূমি পতিত ছিল তাই এখন সমৃদ্ধির সোপান। প্রতিবছর স্থানীয় কৃষকরা নদীর তীরে সবজি আবাদ করে সমৃদ্ধি আনছেন। নদীর পাড় সংশ্লিষ্ট কৃষকরা বাঁকখালী নদীর দু’তীরে সবজির চাষ শুরু করেন। শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এবার সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে। বাঁকখালীর দু’তীরের বিস্তীর্ণ চরে বিভিন্ন জাতের শাক-সবজির ভালো ফলনে কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে।
কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে পৌনে এক কিলোমিটার গেলেই বাঁকখালী নদীর মিঠাছড়ি ঘাট। সেখান থেকে আরও পূর্ব দিকে একদম নদীর ঘাটে চলে গেছে একটি কাঁচা রাস্তা। যে রাস্তা ধরে নামতেই দু’পাশে চোখে পড়ে বেগুন, মুলা, মরিচ, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ নানা রকম সবুজ শাক-সবজির খেত।
সবুজের বুক চিরে আরেকটু সামনে গেলেই দেখা যায়, আরও অসাধারণ সবুজ দৃশ্য। দুই পাশে সবুজের সমারোহের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে প্রবহমান বাঁকখালী নদী। দুই তীরে যতদূর চোখ যায় সবজি খেত আর সবজি খেত। যেনো বহমান নদীর সঙ্গে ছোটে চলেছে সবুজের সারি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদরের চান্দের পাড়া, বাংলাবাজার, মুহুরী পাড়া, মুক্তারকুল, দরগাহ, দক্ষিণ খরুলিয়া, খরুলিয়া কোনারপাড়া, ঘাটপাড়া। রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি, চাকমারকুল, রাজারকুল ইউনিয়নের পূর্ব রাজারকুল, নাশিকুল, খন্দকার পাড়া, সিকদার পাড়া, দক্ষিণ রাজারকুল, ফঁতেখারকুলের হাইটুপি, দ্বীপ শ্রীকুল, অফিসের চর, লম্বরীপাড়া, পূর্ব মেরংলোয়া, কাউয়ারখোপের মনিরঝিল, পূর্ব মনিরঝিল, সোনাইছড়ি, লট-উখিয়ারঘোনা, ডাকভাঙ্গা, মৈষকুম এবং গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া এলাকার বাঁকখালীর নদীর চরের অন্তত ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তীর্ণ জমিতে এ বছর শীতকালীন শাক-সবজির চাষাবাদ হয়েছে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাঁকখালী নদীর দু’তীরের প্রায় ১৫ কিলোমিটারসহ উপজেলাটির বিভিন্নস্থানে প্রায় দুই হাজার একর জমিতে এবার শীতকালীন শাক-সবজির আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে বাঁকখালী তীরে আছে প্রায় ৪০০ হেক্টর সবজি খেত। চাষিরা বলছেন, সবকিছুর পাশাপাশি শাক-সবজির চাহিদাও বেড়েছে। যে কারণে দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে। আর ন্যায্য দাম পেয়ে খুশি চাষিরা।
কোনারপাড়া গ্রামের সবজি চাষি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর ৮০ শতক জমিতে বেগুন-মরিচের চাষ করেছি। ফলন বেশ ভালো হয়েছে। খরচ বাদে ৭০ হাজার টাকারও বেশি লাভ হবে বলে আশা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নদীর তীরে বছরের পর বছর পলি জমাতে এখানকার কম উর্বর জমিতেও ভালো উৎপাদন হয়। তবে পরিশ্রম অবশ্যই করতে হয়। তুলনামূলক কম সার প্রয়োগ করে সবজির ভালো উৎপাদন পাওয়ায় চাষিরা দিন দিন নদীর তীরে সবিজ চাষে ঝুঁকে পড়ছেন।’
মিঠাছড়ির শাহাদাৎ হোসেন এ বছর চার কানি জমি বর্গা নিয়ে মুলা, বেগুন, হাইব্রিড মরিচ, শসা ও ক্ষীরা চাষ করেছেন। এতে তার এক লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
শাহাদাৎ বলেন, ‘এ বছর সবজির চাহিদা বেশি। দামও বেশ ভালো পাচ্ছে সবাই। ন্যায্য দাম পাওয়ায় চাষিরা খুব খুশি।’ রামুর হাইটুপি গ্রামের আব্দুল হক বলেন, ‘৩০ হাজার টাকা খরচ করে ৪০ শতক জমিতে ক্ষীরার চাষ করেছি। ধারণা ৫০ হাজার টাকা লাভ লাভ হবে।’ সবজি চাষি আব্দুস সালাম বলেন, ‘এ বছর প্রায় চার কানি জমিতে বেগুন, আলু ও মরিচের আবাদ করেছি। ভালো লাভ হবে বলে আশা করছি।’
সবজি গ্রাম খরুলিয়া বাঁকখালী নদীর তীরেই ঝিলংজার খরুলিয়া কোনারপাড়া গ্রাম। এ গ্রামে পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৬০। এর মধ্যে সবগুলো পরিবারেই সবজি চাষ এবং বেচা-কেনায় জড়িত। কেউ নিজস্ব জমিতে, কেউ বর্গা নিয়ে।
বর্গাচাষি ছৈয়দ আলম বলেন, ‘এ গ্রামের সব পরিবারই সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী। তাছাড়া শুধুমাত্র এ গ্রাম নয়, পাশের উমখালী, নয়াপাড়া, ঘাটপাড়া, চেয়ারম্যান পাড়া, দরগাহ পাড়াসহ নদীর তীরের অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা এখন সবজি চাষ।’
সদরের কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী কর্মকর্তা সুপন বড়ুয়া বলেন, ‘রামু-সদর শস্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। গর্জনীয়া-কচ্ছপিয়া ইউসিয়নসহ রামুতে উৎপাদিত শীতকালীন শাক-সবজি জেলার বিভিন্নস্থানে যেতো। এখন রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে উখিয়া-টেকনাফে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ শাক-সবজি। যে কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চাষিরা দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশ ভালো পাচ্ছেন। নৌকায় করে আনা হচ্ছে সবজি।’ তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর উৎপাদনও ভালো হয়েছে। বিশেষ করে বেগুন, মুলা, ফুলকপি ও বাঁধাকপির বাম্পার ফলন হয়েছে।’
বাঁকখালীর চরে সবজির হাট
বিপুল সবজির আবাদকে কেন্দ্র করে বাঁকখালী নদীর চরে সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার বসে বড় ধরনের সবজির হাট।
এ হাটের ইজারাদার ছৈয়দ নূর বলেন, ‘সবজির হাটের দিন সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ লাখ টাকার শাক-সবজি বেচা-কেনা হয় এখানে। বেগুন, মরিচ, গোল আলু, মিষ্টি আলু, টমেটো, ফরাশ শিম, কলা, শিম, মিষ্টি কুমরা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বড়ই, ধনেপাতা, তেতুলসহ নানা রকম শাক-সবজি ও মৌসুমী ফল সবই এখানে পাওয়া যায়। এমনকি এখন ফুলের ঝাড়, শুকনো লাকড়িও মেলে এখানে। তাছাড়া বর্ষায় আম, কাঁঠাল, লেবু, জামসহ হরেক রকম বর্ষাকালীন ফলের প্রাধান্য থাকে এ হাটে।’সবজির ভালো উৎপাদন পাওয়ায় চাষিরা দিন দিন নদীর তীরে সবজি চাষে ঝুঁকে পড়ছেন রামু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু মসাসুদ সিদ্দিকী বলেন, ‘এ বছর রামু উপজেলার ১১ ইউনিয়নে প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে শাক-সবজির লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বাঁকখালী নদীর চরে আছে প্রায় ৪০০ হেক্টর। আলু, বেগুন, মূলা, ফরাশ শিম, ক্ষীরা, মরিচ, টমেটো, শিম, মিষ্টি কুমড়া, সরিষাসহ বিভিন্ন শাক সবজি ফলেছে এসব খেতে।’ তাছাড়া আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ কবির হোসেন বলেন, ‘রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়নসহ জেলার আটটি উপজেলায় এ বছর রবি মৌসুমে প্রায় চার হাজার হেক্টর জমিতে আলু, ফেলন, মরিচসহ শীতকালীন শাক-সবজির আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে রামুতে ১ হাজার হেক্টর, চকরিয়ায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর, পেকুয়ায় এক হাজার হেক্টর, কক্সবাজার সদরে দুই হাজার হেক্টর, উখিয়ায় ৭৫০ হেক্টর, টেকনাফে ৬৫০ হেক্টর, মহেশখালীতে ৫০০ হেক্টর ও কুতুবদীয়ায় ৩০০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাক-সবজির আবাদ করা হয়েছে।
নয়াশতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ