বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সুনীল জলরাশি। বিস্তৃত বালুকাবেলা। প্রবাল পাথরের জলকেলি কিংবা উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড় নিয়ে যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ এই সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে অনেক গুণ। কিন্তু এত কিছুর পরও দেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের প্রতিটি সেক্টরেই বিরাজ করছে নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতি। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়তই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে আগত পর্যটকদের।
অব্যবস্থাপনার যাতাকলে পড়ে ধুকছে অর্থনীতির চাকা সচলকারী অন্যতম এই খাতটি। জেলা প্রশাসন, বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি, পর্যটন পুলিশসহ এধরনের আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সক্রিয় উপস্থিতি দেখা গেলেও আজও শৃঙ্খলা ফেরেনি কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে। বছরজুড়েই নেতিবাচক আলোচনায় শিরোনাম হতে থাকে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটি।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের গৌরব বহনকারী এ পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। তারা বলছেন, পর্যটন শিল্প রক্ষার পাশাপাশি পর্যটকদের কক্সবাজারমুখী করতে এসব নানা অনিয়ম রোধে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি জরুরি। অন্যথায় একটা সময় এসে কক্সবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে পর্যটকরা।
জানা গেছে, সৈকতে ভিক্ষুক, গরুর অবাধ বিচরণ, হিজড়া, বডি ম্যাসেজ, চিপস্, পানি, সিগারেট ও ঝালমুড়িওয়ালাদের উৎপাত দীর্ঘদিনের। অভিযোগ রয়েছে, এসব ভ্রাম্যমাণ হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ টাকা টাকা চাঁদা আদায় হয়। সংশ্লিষ্টদর মনোনীত বীচ ‘কর্মীরা’ সবার কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে তাদের বুঝিয় দেয়। কেউ টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাকে শারীরিকভাব নাজেহাল এবং এলাকা ছাড়া করা হয়।
অভিযোগ আছে, এই চাঁদাবাজির ভাগ-বাটোয়ারায় রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। তারা সরাসরি চাঁদা না নিলেও কৌশলে কোটি কোটি টাকা যাচ্ছে তাদের পকেটে। আর এই অর্থ খোদ ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে ওইসব প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এসব নিয়ে বিশ্বনন্দিত সমুদ্র সৈকতের ব্যবস্থাপনার সমালোচনার শেষ নেই। ক্ষুন্ন হচ্ছে এ সৈকতের ভাবমূর্তি। অথচ এসব ‘গুরুতর’ সমস্যা কখনো রোধ করা যায়নি। উল্টো সম্প্রতি নতুন করে যোগ হয়েছে গরুর অবাধ বিচরণ ও পর্যটক টার্গেট করে ভাড়া নৈরাজ্য!
ভোরের আলো না ফুটতেই দালাল-ফড়িয়াদের উপদ্রব, এর উপর পর্যটন এলাকায় চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনা তো নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও আছে সৈকতে ফটোগ্রাফার, ঘোড়সওয়ারী ও বীচবাইক ব্যবসায়ীদের গলাকাটা বাণিজ্যের যন্ত্রণা। ফলে নানাবিধ তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে পর্যটন এলাকা ত্যাগ করেন বেশিরভাগই পর্যটক।
সম্প্রতি মা’কে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে এসে সাকলায়েন রাসেল নামের এক ডাক্তার তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের আইডি থেকে পোস্ট করে জানান, প্রতি মিনিটে একজন কলা, চানাচুর, চা-কফি বিক্রেতাদের উৎপাত। প্রতি মিনিটে একজন ভিক্ষুকের আবদার। একটু পরপর ছবি তোলেন, বাইকে ওঠেন, ঘোড়ায় ওঠেন। আছে, ক্ষুদে থেরাপিস্ট (হাত পা মাথা বানায় দেয়) তাদের স্পর্শ। এয়ারপোর্টে ফেরার সময় অটোওয়ালা অনেকটা ঠেক দিয়েই সর্বোচ্চ ৮০ টাকার ভাড়া ২০০ টাকা নেওয়ার কথা লিখেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এয়ারপোর্টের এন্ট্রির স্ক্যানিং মেশিনে অফিসারদের সেই সুন্দর ব্যবহার। সালাম দিয়ে বললেন, ‘স্যার যত্ন করে ব্যাগ পার করেছি’, কিছু খুশী করেন, না শোনার ভান করে বোর্ডিং পাশ নিতে গেলাম। ফাইনাল ডিপারচারের স্কেনিং মেশিনের সামনে গেলাম, কর্তব্যরত অফিসার আগেই স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বললেন, আপনার সব লোকদের সুন্দর মত পার করেছি। বুঝলাম, আবারও সালাম দিয়ে বকশিস চাইবে কারণ এখানে পার করার কিছুই নাই। চেকিং শেষ হওয়া মাত্রই সালাম ও খুশী করার আবেদন। হোটেল ভাড়া, রিকশাভাড়া, খাবারের যেমন খুশি তেমন মূল্যের কথা নাইবা বললাম।’
ডাক্তার সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‘সারাবিশ্বে ট্যুরিস্টদের প্রতি স্থানীয়দের আচরণ হয় এক রকম যাতে বারবার আসে, অন্যদের আসতে অনুপ্রাণিত করে। আর আমাদের দেশে ট্যুরিস্টদের প্রতি তাদের আচরণ- পাইছি আপনাকে জীবনে আর নাও আসতে পারেন, তাই ডলা যা দেওয়ার এখনই দেই!’ পরিবেশ ট্যুরিস্ট বান্ধব না করে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত বলে গলা ফাটালে কোন লাভ হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
কয়েকজন পর্যটক এ প্রসঙ্গে বলেন, তিন দিনে কক্সবাজার ভ্রমণ করে বিমান ভাড়া হোটেলে থাকা খাওয়ায় যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় সে টাকা দিয়ে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সহজে ভ্রমণ করা যায়। তাদের প্রশ্ন, তাহলে মানুষ কেন কক্সবাজার ভ্রমণ করবে? তারা বলেন, পর্যটকদের সাথে পর্যটন ব্যবসায়ীদের দুর্ব্যবহার অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ঘৃণ্য। এটি দেশের জন্যও অপমানজনক। এর দায় এড়াতে পারেন না জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরাও।
পর্যটকদের অভিযোগ, হোটেল থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, যানবাহনসহ সবখানে বাড়তি ভাড়া ও অসদাচারণের শিকার হওয়ার পাশাপাশি চরম হয়রানিতে পড়ছেন তারা। সৈকত ব্যবস্থাপনার জন্য বিচকর্মী ও ট্যুরিস্ট পুলিশ সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থাকলেও কেন দিন দিন নানা উৎপাত বাড়ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
এছাড়াও কক্সবাজারের পর্যটন এলাকাগুলোতে ভিক্ষুকদের উৎপাত বেড়েই চলেছে। এদের জন্য শান্তিতে ঘুরতে পারছেন না ভ্রমণে আসা মানুষগুলো। যেখানে সেখানে এসে টাকা চেয়ে বিরক্ত করছে ঘুরতে আসা মানুষদের। সম্প্রতি বিভিন্ন পর্যটন স্পট ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
দুই দিনের ছুটিতে সহকর্মীদের সঙ্গে ঢাকা থেকে প্রথমবার কক্সবাজার এসেছেন আলী আরমান তপু। পেশায় তিনি ব্যাংকার। হাতে ছুটি কম থাকায় হোটেলে চেক ইন করেই পর্যটন কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখতে বেরিয়েছেন। প্রথমে গিয়েছেন সমুদ্র সৈকত দর্শনে। কথার মাঝে তপু নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘হোটেলে ঢোকার মুখে ইজিবাইক থেকে নামতেই টাকা চেয়ে ঘিরে ধরছে এক শ্রেণির মানুষ। এরপর যখন সৈকতে গিয়েছি তখনও একইভাবে সাহায্যপ্রার্থীদের আর্তনাদ শুনতে হয়। প্রথমদিকে কয়েকজনকে সাহায্যও করেছি কিন্তু এ সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যাটি অগণিত।’
সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে কথা হয় নরসিংদী থেকে আসা পর্যটক মুক্করমের সঙ্গে। তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে মানুষ আসে রিলাক্স করতে। ঠিক এই সময়ে ভিক্ষুক, গরু বা কোনো অযাচিত প্রাণীর উৎপাত খুব অস্বস্তিকর।’
জামালপুর থেকে আসা কাউসার পর্যটক দম্পতি নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘গরু দেখলে নারী ও বাচ্চারা এমনিতে ভয় পায়। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে অনেক পুরুষও। কিন্তু সৈকতে বেড়াতে এসে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া খুবই বিড়ম্বনার।’
মধুচন্দ্রিমা কাটাতে কক্সবাজারে এসেছেন নবদম্পতি সোহেল ও আশা। বিপণী বিতান থেকে খাওয়ার হোটেলে ঢুকতে-বের হতে তাদেরও পোহাতে হচ্ছে একই বিড়ম্বনা। সোহেল নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘মানুষ পর্যটন স্পটে রিফ্রেশ বা অবকাশ যাপনের জন্য আসে। প্রতি পদক্ষেপে এমন বিড়ম্বনা অসহনীয়। থেরাপিষ্টদের উৎপাতে পর্যটকরা বিড়ম্বনাসহ নানা ধরনের হেনস্থার শিকার হচ্ছেন।’ স্থানীয়রা বলছেন এ অবস্থা ক্রমেই বেগতিক হচ্ছে।
সৈকতের লাবণী পয়েন্টের সামনে ভিক্ষা করতে দেখা যায় ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিকে। তিনি নয়া শতাব্দীকে জানান, তার নাম আমজেদ মোল্লা। মেয়ের বিয়ে ও নিজর শরীরের নানা সমস্যার কারণে পর্যটকদের কাছে অর্থ চাচ্ছেন তিনি। এ সময় বয়স্ক ভাতা না পাওয়ার অভিযাগ করন তিনি। বলেন, ‘শরীরে শক্তি না থাকায় কিছুই করতে পারি না। এ কারণেই ভিক্ষা করছি।’ তবে তিনি দাবি করেন, কক্সবাজারে যেসব ভিক্ষুক দেখা যাচ্ছে তাদের অনেকেই রোহিঙ্গা অর্থাৎ বাংলাদেশি নয়।
রাজধানী ঢাকার ধানমণ্ডি থেকে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে আসা হিল্লল চৌধুরী। তিনি নয়া শতাব্দীকে বলন, ‘রেস্টুরেন্টের নাম লাইভ ফিশ পর্যটকদের ওপর জুলুম করছে। এটি প্রশাসনের অবশ্যই নজর দেয়া দরকার। এভাবে চললে পর্যটকরা কক্সবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।’
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে বেড়াতে আসা জব্বার চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘কক্সবাজার বললে যে আবহ মানুষর মানসপটে ভাসে সেই তুলনায় চারপাশটা অগোছালো। ময়লা, আবর্জনা, অপরিকল্পিত স্থাপনায় মনে হচ্ছে এটি ইট-পাথরের কোন বস্তি। সৈকত দেখলে যে আনন্দ লাগে, পেছনে ফিরলে তেমনটি লাগে বেদনা। পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে তদারকি নেই বললেই চলে। অল্প চোখের দূরত্বে ইজিবাইক ভাড়া ১০০ টাকা নিচে যায়ই না। দলবদ্ধ হলে পুরো গাড়ি নেওয়া যায়, কিন্তু দুজন বা সিঙ্গেল হলেও রিজার্ভ ছাড়া যাত্রী তুলেই না। পর্যটন এলাকায় খরচ বাড়লে লোকজন বিমুখ হন।’
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘ট্যুরিস্ট পুলিশের কাজ হচ্ছে পর্যটকদের নিরাপত্তা দেয়া। তারপরও হকার, ভিক্ষুকের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ভবিষ্যতে পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে সেজন্য দ্রুত পদক্ষপে নেওয়া হচ্ছে।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবগত হয়ে আমি নিজেই বীচে অভিযানে যাই। আমরা একদিক দিয়ে গেলে তারা অন্যদিক দিয়ে পালিয় যায়। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়েছে এবং পর্যটকরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে ও নিরাপদে ঘুরতে পারেন সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ