ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাইড শেয়ারিং যখন নারীর পেশা

প্রকাশনার সময়: ৩১ আগস্ট ২০২১, ১০:২৮

অনলাইনভিত্তিক মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং অ্যাপের নারীচালক সাবিহা আক্তার। যোগাযোগের হয়রানি থেকে উদ্ধারের মাধ্যম একটি স্কুটি। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট সাবিহা। ছোটবেলা থেকেই তিনি একটু দুরন্ত স্বভাবের। নারী-পুরুষ নিয়ে কোনো সামাজিক সংশয়বোধ করেননি কখনো। চালকের আসনে বসে নানারকম অভিজ্ঞতা থাকলেও ভালো অভিজ্ঞতাই বেশি। তিক্ততা কিছু থাকলেও সামলাতে হয় উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে। নিজের সাহসটাই প্রথম নিরাপত্তা। প্রতিদিন কর্মস্থলে বাহন সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি নিজের আয়ও হচ্ছে। তার পাশাপাশি অনেক নারী এ কাজে এগিয়ে আসছেন।

নানা কর্মক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে নারী-পুরুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনমান অর্জনের ব্যবস্থা, নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস তৈরি করা, পেশাগত দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন এবং সব ধরনের চ্যালেঞ্জিং কাজে সম-অধিকার অর্জন। নানা বাধা-বিঘ্ন, অত্যাচার-নির্যাতন সত্ত্বেও বিভিন্ন সূচক বলছে, নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এখন ধনী দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশে^র প্রথম ১০টি দেশের তালিকায়। অথচ স্বাধীনতার পরপর পরিস্থিতিটা এমন ছিল না। নারী ছিল সব দিক থেকে পিছিয়ে।

শিক্ষা, চাকরিতে অংশগ্রহণ তো বটেই, এমনকি নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল নেতিবাচক। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও ছিল না স্বাধীন এই দেশে। তবে বর্তমানে তাদের দেয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান। বীরাঙ্গনাদেরও সম্মান জানাচ্ছে বিভিন্ন মহল।

নারীর এই ক্ষমতায়নকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক। অর্থাৎ অর্থনীতির মূলধারায় নারীর অংশগ্রহণ হলো অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। সামাজিক ক্ষমতায়ন হচ্ছে নারীর অধিকার ভোগ এবং রাজনৈতিক চর্চায় নারীর পূণাঙ্গ অংশগ্রহণের সুযোগ হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন।

দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিসভা, প্রশাসন, সব খাতেই নারীর অগ্রযাত্রা দৃশ্যমান। বিশ্বের আর কোনো দেশের রাজনীতিতে নারীর এত উচ্চাসন নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে সামগ্রিক উন্নয়নের রোল মডেল। তা ইতোমধ্যে স্বীকৃত এবং চিহ্নিত। লিঙ্গ সমতায়ও কিছু জায়গায় বাংলাদেশ প্রথম স্থানে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়, উন্নয়নের ১৪টি সূচকের মধ্যে বাংলাদেশ ৪টিতে বিশ্বের অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ‘দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ-রিপোর্টে’ বিশ্বের ১৪৪টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। সামগ্রিক উন্নয়নে নারী-পুরুষ সমতায় বাংলাদেশের জায়গা ৪৭-এ। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এই সমতার মাপকাঠি একেবারে শ্রেষ্ঠ আসনে বাংলাদেশ।

২০০৬ সাল থেকে এই বিশ্বে অর্থনৈতিক ফোরাম লিঙ্গ সমতার ওপর তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করলেও ২০১৫-১৬ সালে বৈশ্বিক অবস্থানে একটু পিছিয়ে ছিল। ২০১৬ সালে যেখানে বাংলাদেশের জায়গা ছিল ৭২তম, সেখানে মাত্র ১ বছরে ২৫টি দেশকে অতিক্রম করে ৪৭তম পর্যায়ে স্বীয় স্থান মজবুত করে লিঙ্গ সমতার যে চারটি সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করে, সেটা ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণভাবেও প্রমাণিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দৃপ্ত। ইউপি, উপজেলা, জেলাসহ তৃণমূল পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব তাদের সৃজনশীলতা দ্বারা, তাদের সঠিক বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান করে চলেছে সাধারণ জনগণের নানা সমস্যার।

শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের তুলনায় কোনোভাবেই কম নয়। বিশেষ করে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় সমতাভিত্তিক অনুপাতে নারী-পুরুষ একেবারে সমানই শুধু নয়, সারা বিশ্বে অগ্রণী অবস্থানেও বটে। বাংলাদেশে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নের সঙ্গে নারী যে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে নেই, তার জরিপ উঠে আসে এই বিশ্বে প্রতিবেদনে। গত কয়েক বছরের সরকারপ্রধানের সূচকেও নারী-পুরুষের সমতায় বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে। তবে স্বাস্থ্যসেবা, শ্রমবাজার, উচ্চতর শিক্ষা কিংবা মন্ত্রী-উপমন্ত্রীর পদে নারী এখনো পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে। অবশ্য আইনি পর্যায়ে নারী-পুরুষের অনুপাত, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপকসহ অন্যান্য পেশায়ও নারী-পুরুষের সমান অংশীদারত্ব উল্লেখ করার মতো, যা এই লিঙ্গ সমতা প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়। যা সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে বিশ্বের বিশিষ্টতম অবস্থানে অভিষিক্ত করে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় তো বাংলাদেশ একেবারে রাজসিক মর্যাদায়। কারণ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশ থেকে এত পিছিয়ে যা বর্ণনায়ও আসে না।

গত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলেও দেখা গেছে, সব শিক্ষা বোর্ডেই মেয়ে শিক্ষার্থীরা ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন অথবা সমান ফল করছেন। এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডেও মেয়েরা পেছনে ফেলেছে ছেলেদের। চ্যালেঞ্জিং কাজ যেমন বিমানবাহিনীর প্যারাট্রুপারও রয়েছেন নারী। আর বিমানবাহিনীর জঙ্গি বিমানও উড়াচ্ছেন নারী পাইলট। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিতেও নিয়োগ হয়েছে নারী ব্যাটালিয়ন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়নের জন্য মেয়েদের শিক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা ৬ থেকে ১০ বছরের সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক এবং বিনামূল্যে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত সব শিশু বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক পেয়ে থাকে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব মেয়ের সরকারি বিদ্যায়তনগুলোয় শিক্ষা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহিত করতে এবং ঝরেপড়ার হার কমাতে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষার জন্য এই উৎসাহমূলক কৌশলের ফলে লৈঙ্গিক সমতা সৃষ্টি হচ্ছে।

নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে সম্ভব করতে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাদের ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং ক্ষুদ্র ও মধ্যম নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে। বিবিধ ধরনের ভাতা প্রদানের মাধ্যমে বিস্তৃত সামাজিক নিরাপত্তা জাল প্রকল্প নেয়া হয়েছে। যেমন দুস্থ নারী ভাতা, মাতৃকালীন এবং দুগ্ধদায়ী মায়ের জন্য ভাতা, অক্ষম মায়ের ভাতা, তালাকপ্রাপ্তা ভাতা ইত্যাদি। অরক্ষিত গ্রুপ পোষণ (ভিজিএফ) দেয়া হয় অরক্ষিত অতিদরিদ্র নারীর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য।

গ্রামের নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য, জামানতদারসহ ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হচ্ছে। দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত পোশাকশিল্পে কর্মরতদের প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী। চা ও চামড়াশিল্পেও ব্যাপকভাবে কাজ করছেন নারীরা। কৃষি উৎপাদনে নারীর অংশগ্রহণের সুবিধা দিতে কৃষি-সংক্রান্ত প্রযুক্তি এবং ঋণ দেয়া হয় কৃষিজাত প্রক্রিয়াকরণ, গার্হস্থ্য বাগান, নার্সারি, মৌচাষ এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডের জন্য।

প্রান্তিক ও ভূমিহীন চাষিদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যাদের ৫০ শতাংশই নারী। ‘একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্পে’ গ্রামের দরিদ্র নারীদের আরো বেশি অংশগ্রহণ, একটি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নারীদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে প্রত্যেক গ্রামের প্রতিটি গৃহে। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ানোর জন্য জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা আরো ৫টি বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের শেষ পর্যায়ে ১২ হাজারের বেশি নারী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষা মিশনগুলোয়ও লৈঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গিটি সমন্বিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অভিযানগুলোয় বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বেশি নারী পুলিশ পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশি নারী শান্তি রক্ষাবাহিনী লিঙ্গভিত্তিক সংঘাত-সহিংসতা, নারী ও শিশুর জন্য নিরাপত্তা, স্থানীয় নারী পুলিশ অফিসারদের উপদেশ ও পরামর্শ ইত্যাদির মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতায়ন সেই সঙ্গে সামাজিক সংযোগ বাড়াচ্ছে। জনসংযোগ মন্ত্রণালয়ের এক তথ্যে উঠে আসে উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনে নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল চিত্র।

সেখানে সচিবের মতো সর্বোচ্চ আমলাতান্ত্রিক অবস্থানে ১০ জন নারী সফলতার সঙ্গে এই শীর্ষে নিজের জায়গা মজবুত করেন। শুধু তা-ই নয়, ছয়জন নারী জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে থেকে নারীর ক্ষমতায়নকে মহিমান্বিত করেছেন। ১৬ জন নারী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের পদে সফলভাবে অধিষ্ঠিত আছেন, যা বাংলাদেশের নারীর প্রগতি এবং ক্ষমতায়নকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান করে। বর্তমানে সংখ্যায় কম হলেও সময়ের দাবিতে সেটা আরো বাড়তে থাকবে।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ