চলতি বছরের এপ্রিলের ১৩ তারিখ। ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন পিএমখালী ইউনিয়ন আ’লীগের সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিন চৌধুরী (৬০)। অসুস্থ শরীরে একটা ফোন রিসিভ করেই বিমর্ষ হয়ে পড়েন তিনি। ফোনটি এসেছিল তার এক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে। তিনি জানান- সদর উপজেলা আ’লীগের আহবায়ক মাহমুদুল করিম মাদু দলীয় গঠনতন্ত্র না মেনে মনগড়া একজনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করেছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় কামাল ঢাকা থেকে এসে তার ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদটি ফিরে পাওয়ার আশায় মাদুসহ বিভিন্ন নেতাদের সাথে যোগাযোগ করেন।
তার পর থেকে তিনি বহুবার জেলা আ’লীগের সভাপতি/সম্পাদকসহ পার্টি অফিসে লিখিত অভিযোগ নিয়ে গেছেন যা তার মতে– ২০ বার। কিন্তু নেতারা তার প্রতি শুধু উদাসীনতা ও অবহেলা দেখিয়েছেন। তার পদটি পেতে তাকে কোনো সহযোগিতা করা হয়নি।
তিনি দাবি করেছেন, উপজেলা আ.লীগের আহবায়ক মাদু সাংগঠনিক গঠনতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে মাদুর ম্যাইম্যানখ্যাত ২নং সহ-সভাপতি কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বলে ঘোষণা করে এখন তিনি তাদের হুমকির মুখে আছেন। জেলা নেতাদের লিখিত আবেদন করেও তিনি এখন পর্যন্ত কোন প্রতিকার পাননি।
কামাল বলেন, ‘এটি অবিশ্বাস্য। মাদুর আশ্রয়ে থাকা পিএমখালী ইউনিয়নের নানা বিতর্কিত সভাপতি মোর্শেদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সংগঠনের নিয়ম অনুযায়ী সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে আমি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হই, তবুও ওই মাদু এবং তার সাথে থাকা চক্রটি আমাকে বাদ দিয়ে কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করেছে।’
জানা গেছে, কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই দুই ধারায় বিভক্ত। প্রায় এক যুগ ধরে নানা ইস্যুতে নিয়মিতই আলোচনা-সমালোচনার শিরোনাম হচ্ছে কক্সবাজারকে ঘিরে। কেউ কাউকে তোয়াক্কা করছেন না; জড়াচ্ছেন প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে। অনেক সময় সেই দ্বন্দ্ব শিষ্টাচারকেও ছাড়িয়ে যায়। কেন্দ্র থেকে বারবার হুশিয়ারি দিলেও আমলে নেন না কেউ। এমন বাস্তবতায় কক্সবাজারের পৌর, উপজেলা, ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত নিয়ে বিশেষ নজর দেওয়ার নির্দেশ এসেছে দলের হাইকমান্ড থেকে। তাই এবার ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি দূর করার উদ্যোগ নিচ্ছে কেন্দ্র। পুনর্গঠন করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের সব কমিটি। এমনকি বিগত সময়ে যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কাজ করেছেন, সাংগঠনিক বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। এমতাবস্থায় কমিটিগুলোকে পূর্ণগঠন করতে গিয়ে নিজেদের পদ-পদবী ও অবস্থান ধরে রাখতে নানা অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্র ঘোষিত নির্দেশনা মানতে গিয়ে উপজেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ধরণের অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে সদরের পিএমখালী ইউনিয়নে আশ্রয় নিচ্ছে ছলছাতুরির। ইতোমধ্যেই ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের একাধিক কমিটি নিয়ে বাণিজ্য এবং মাইম্যান তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সদরের আহবায়ক মাহমুদুল করিম মাদু দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে তড়িঘড়ি করে টাকার বিনিময়ে শিবির ক্যাডার, বিএনপি জামায়াত সমর্থিত লোকজনকে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক দেখিয়ে কমিটির অনুমোদন দিচ্ছে। এমনকি টাকার বিনিময়ে কমিটিতে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদেরও স্থান দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে তৃনমূল নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, মাদুর বিরুদ্ধে সদরের দায়ীত্বপ্রাপ্ত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সাংগঠনিক টিমসহ জেলা আ’লীগের সভাপতি/সম্পাদক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেনা; উল্টো মাদু তৃনমূল নেতাকর্মীদের উপর যখন তখন হামলে পড়ছেন এবং বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন।
এমন অভিযোগের সত্যতা মিলে প্রতিবেদকের হাতে আসা এক ভিড়িওতে। এতে দেখা যায়, গত ২১ মে পিএমখালী ইউনিয়ন আ’লীগের বর্ধিত সভা চলাকালে জেলা আ’লীগের নেতাসহ সাংগঠনিক টিমের নেতাদের কাছে মাদুর নানা অনিয়ম ও রাতের আঁধারে পকেট কমিটি দেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ দেন। এসময় মাদু স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুরব্যবহারসহ দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এসব কারণে সদরের পিএমখালীতে প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গণবিস্ফোরণের আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নাম্বার ওয়ার্ড থেকে কমিটি নিয়ে নয়ছয়, পদবাণিজ্য এবং দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাকর্মীদের নাম কমিটি থেকে বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটির অনুমোদন দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী নেতাকর্মীরা।
৭নং ওয়ার্ডের সভাপতি মেহের আলী ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন জানান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা চ্যাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে এখন দলে নিজেদের অবস্থান অক্ষুন্ন রাখতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নিজেদের লোক বসানোর পায়তারা করছে। প্রবাস ফেরত দুই শিবির ক্যাডার ছৈয়দ কামালকে সভাপতি ও তার ভাই রেজাউল করিমকে সাধারণ সম্পাদক দেখিয়ে মোটা অংকের টাকার লেনদেনের মাধ্যমে রাতারাতি কমিটি দিয়ে দেয়। অথচ এই দুই ভাই গত ১০ বছর ধরে প্রবাসে আছেন।
একইভাবে ৮নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মমতাজ আহমদ অভিযোগ করে বলেন, ‘পিএমখালীতে সাম্প্রতিক চ্যাঞ্চল্যকর মোর্শেদ হত্যার পর এই ওয়ার্ডে নতুন করে আরেকজনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে বলে সংবাদ চাউর করা হয়। পরবর্তীতে এর সত্যতাও পাওয়া যায়। উক্ত ওয়ার্ডের সভাপতি ডা. হারুনুর রশিদ সংগঠনের প্রটোকল ভেঙে রহমত উল্লাহ প্রকাশ গুরা ভাই নামে একজনকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন এবং সাংগঠনিক সভা সমাবেশ ও মিটিং বৈঠকেও রহমত প্রকাশ গুরা ভাইকে ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক পদে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেন।’
হারুনের ব্যাপারে জানা যায়, হারুনের পুরো পরিবার জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। কিন্তু উপজেলা আহ্বায়ক কমিটির প্রধান মাহমুদুল করিম মাদু এবং পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা ও মোর্শেদ হত্যার পলাতক আসামি মালেক গংদের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় গুরা ভাই উক্ত ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক পদটি ভাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।
মমতাজ আহমদ আরও বলেন, ‘উক্ত ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ শূণ্য এলাকা। এখানে আগে আমরা যেকজন আওয়ামী লীগ করতাম তাদের হিন্দু বলা হতো, অবজ্ঞা করা হতো, সমাজ থেকে বের করে দিতে চাইতো। আজ এসব কিছুকে চড়াই উৎরাই মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে গত এক যুগের যেকোনো পর্যায়ের নির্বাচনে নৌকা প্রতীককে সর্বোচ্চ ভোট এনে দিতে পেরেছি। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের সুসময়ে সামান্য কিছু টাকা এবং নিজেদের সাংগঠনিক ভোট ধরে রাখতে নিজেদের মতো কিছু লোক ধরে এনে সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।’
৯নং ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের জানান, উক্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ২০১৭ সালে প্রবাসে চলে যায়। এরপরে পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা আলাল মাত্র ১ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এলাকার চিহ্নিত এবং কুখ্যাত জামাত ক্যাডার সাইফুলকে উক্ত ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক বানিয়ে দেয়। সাইফুল বর্তমানে চ্যাঞ্চল্যকর মোর্শেদ হত্যায় জড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে আছে।
এদিকে তৃণমূল পর্যায়ে পদবঞ্চিত এবং দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মাঝে একধরণের চাপাক্ষোভ ও হতাশা কাজ করছে। তাদের অভিযোগ, শুধুমাত্র ঊর্ধ্বতন নেতারা নিজেদের পদ পদবী ধরে রাখতে মন মতো কাউন্সিলর বানাতে এভাবে পকেট কমিটি দিয়ে যাচ্ছে। এতে করে দিন শেষে সংগঠনই ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে মনে করেন তারা।
এবিষয়ে সদর উপজেলা আ’লীগের আহবায়ক মাহমুদুল করিম মাদু এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘মোর্শেদ হত্যাকাণ্ডের পর স্থানীয় আ’লীগের অবস্থা বেগতিক দেখে কামাল ইউনিয়ন আ’লীগ থেকে পদত্যাগ করে। সম্প্রতি একটি চক্র নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেছে আমার বিরুদ্ধে। এইসব অভিযোগ তারই অংশ বলে মনে করছি। ওই ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ড সম্মেলন এবং কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠন করা হবে।’
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ