জাতীয় পার্টির (জাপা) দেবর-ভাবির দ্বৈরথ যতই দিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে। এখন টপ অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে এই দ্বন্দ্ব। যা গড়িয়েছে সংসদেও। পার্লামেন্টে নতুন করে বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা নির্বাচন করে পাল্টাপাল্টি স্পিকারকে চিঠি দিয়েছে বেগম রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের। এই চিঠির সুরাহা আসতে পারে চলমান ২০তম সংসদ অধিবেশনে।
এ নিয়ে জাপার নেতাকর্মীদের সজাগ দৃষ্টি চলতি অধিবেশনের দিকে। বিরোধীদলীয় নেতার আসনে কে বসবেন রওশন এরশাদ, নাকি জি এম কাদের? উপনেতার আসনে জি এম কাদের, নাকি কাজী ফিরোজ রশিদ? উপনেতা হওয়ার দৌড়ে শোনা যাচ্ছে মসিউর রহমান রাঙ্গার নামও— এসব প্রশ্ন ঘিরেই উত্তেজনা বাড়ছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে। বড় এই দুই পদ নিয়ে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের সঙ্গে দলটির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরের চলছে কাড়াকাড়ি। দলীয়ভাবেও প্রতিহতে পাল্টাপাল্টি প্রস্তুতি নিচ্ছে রওশন ও কাদেরপন্থিরা।
এদিকে, প্রায় দীর্ঘ এক বছর ব্যাঙ্ককে চিকিৎসা শেষে রওশন এরশাদ দেশে ফিরছেন আগামী মঙ্গলবার। তার প্রত্যাগমন ঘিরে উত্তেজনা ও আগ্রহ বাড়ছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। ওই দিনই বিমানবন্দরে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। বিমানবন্দর থেকে গাড়ি শোভাযাত্রা করে তাকে গুলশান-২ নম্বর বাসভবন পর্যন্ত নিয়ে যাবেন তারা।
রওশনপন্থিরা বলছেন, ম্যাডামকে ৩১ অক্টোবর হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়ার কথা রয়েছে। পরের দিন ১ নভেম্বর দুপুরে দেশের উদ্দেশ রওনা দেবেন। এরপরের দিন রওশন এরশাদ সংসদ অধিবেশন ও সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। তখনই অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাবে। বহিষ্কার ও পদ হারানোর ভয়ে এখন অনেকেই মুখ খুলছেন না। তবে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ম্যাডামের উপস্থিতিতে পার্টির অনেক এমপি মুখ খুলবেন বলেও আশা তাদের।
জানতে চাইলে সদ্য জাপার সব পদ থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মহাসচিব ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা নয়া শতাব্দীকে বলেন, আর একটা দিন অপেক্ষা করেন দেখতে পারবেন বিরোধীদলীয় নেতার আসনে কে বসছেন। জি এম কাদেরের সঙ্গে পার্টির ৫ এমপি ছাড়া আর কেউ নেই। যদিও এর আগে গত ২৩ অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, আসন্ন অধিবেশনে সংসদে জি এম কাদেরের বিরোধীদলীয় উপনেতার আসনটি সরে যাবে। রওশন এরশাদের পাশের চেয়ারে বসবেন অন্য কেউ। সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। জি এম কাদেরের চেয়ার কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
রওশন এরশাদের সংবর্ধনা বিষয়ে জানতে চাইলে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার মনিরুজ্জামান টিটু নয়া শতাব্দীকে বলেন, মাড্যাম দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরছেন। তাই ম্যাডাম যেদিন দেশে আসবেন সেদিন সারাদেশের নেতাকর্মীরা বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকবেন আশা করছি। আমার মনে হয়, ম্যাডাম বিমানবন্দর থেকে সরাসরি নিজের বাসভবনে উঠবেন।
সূত্রমতে, গত ১ সেপ্টেম্বর জি এম কাদের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে দলের এমপিরা বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে জি এম কাদেরকেই বেছে নেন। বৈঠকের পর সংসদীয় দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি চিঠি জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে ওই চিঠির স্বাক্ষরদাতা, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা স্পিকারের কাছে দেয়া চিঠিটি প্রত্যাহার করে নেন। এ খবর জানার পরে জি এম কাদের ফের সংসদীয় দলের বৈঠক ডেকে সবার সম্মতি নিয়ে নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতা মনোনীত করে নেন।
এ ছাড়া তিনি দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রত্যেকের কাছ থেকে এ বিষয়ে সম্মতি নেন, যাতে পরবর্তীতে কেউ অস্বীকার করতে না পারেন। তার এই মনোনীত হওয়ার বিষয়টিও স্পিকারকে চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়। তবে স্পিকারের কাছ থেকে বিরোধীদলীয় নেতার পদের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
অন্যদিকে বিরোধীদলীয় উপনেতার আসন থেকে জি এম কাদেরকে অপরসারণ করতে গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্পিকারকে চিঠি দিয়েছেন রওশন এরশাদ। নতুন উপনেতা হিসেবে ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ নাম প্রস্তাব করেছেন। ফলে এই দুই চিঠির সুরাহা আসতে পারে চলতি অধিবেশনে।
জানা যায়, যেহেতু এখনও স্পিকারের কাছ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি, তাই জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদে এখন পর্যন্ত রওশন এরশাদ বহাল রয়েছেন। এমনকি সংসদের বিরোধী দলের নেতার আসনে তিনিই বসবেন। আর স্পিকারের সিদ্ধান্তের আগে বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ারে যদি জি এম কাদের বসেন সেটি সংসদীয় রীতি ভঙ্গ হবে। সংসদে কথা বলতে গেলে তাকে ওই চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে উপনেতার আসনে বসেই মাইক নিতে হবে। তিনি বিরোধীদলীয় নেতার মাইক পাবেন না। ফ্লোর বা মাইক পাবেন উপনেতা হিসেবে।
দলীয় সূত্রমতে, দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বের শুরু গত ৩১ আগস্ট। রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে ২৬ নভেম্বর পার্টির কাউন্সিল আহ্বান ও একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। এতেই চটে যান দেবর জি এম কাদের। এর জেরে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে রওশনকে সরাতে গত ১ সেপ্টেম্বর স্পিকারকে চিঠি দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাকে বহিষ্কার করা হয়।
এ ঘটনায় উল্টো ক্ষুব্ধ হন রওশন এরশাদ। তিনি সরকারি এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই দলকে দ্বিখণ্ডিত করার চেষ্টায় জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান করেছেন বলে ধারণা জাপা নেতাদের। দলের ক্রাইসিস থেকে বের হতেই রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা রাখতে চাচ্ছেন না তারা। রওশনপন্থিদের কাউন্সিলও যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে চান জি এম কাদেররা।
কাদেরপন্থিদের সূত্র বলছে, শেষমেশ রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে সরে যেতে হচ্ছে। এ পদে মসনদে বসছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। আর উপনেতা হচ্ছেন পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
আর মসিউর রহমান রাঙ্গা পদ হারানোর পর বিরোধী দলের চিফ হুইপ হতে যাচ্ছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম। সংসদের ২০তম অধিবেশনের প্রথম দিনেই বিষয়গুলোর সুরাহা হতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে জাতীয় পার্টির জন্য চলতি অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ। আসতে পারে অনেক পরিবর্তন।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম তালুকদার এমপি নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমাদের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। জাতীয় পার্টির সব সংসদ সদস্য মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিরোধীদলীয় নেতা পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সংসদের চিঠি দিয়েছি।
রওশন এরশাদের দিকে দলীয় এমপিরা চলে আসতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই ধরনের কোনো দলীয়ভাবে এখনও হয়নি। আগের অধিবেশনের সময় কথা হয়েছিল। এর পর কী হয়েছে তা কিছুই জানি না বা বলতেও পারি না। আমি পার্টির কোনো বড় নেতাও নই। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়েও কোনো নেতাও নই।
জানতে চাইলে জাপার আরেক এমপি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ নয়া শতাব্দীকে বলেন, চলতি অধিবেশনে জানা যাবে বিরোধীদলীয় নেতা। তবে জাতীয় পার্টির নাম ভাঙিয়ে কিছু মানুষ তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বার বার বলেছেন তার সঙ্গে ভাবি রওশন এরশাদের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন প্রয়াত এরশাদের ভাগিনা আদেল রহমান আদেল এমপি। তবে তিনি কতটুকু করতে পেরেছেন তা এখনও জানি না।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ