দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় পেতে মরিয়া মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তাই নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কঠোরতা নীতি থেকে সরে এসে বহিষ্কৃত ও পদ হারানো পরীক্ষিত নেতাদের দলে ভেড়ানোর কথা ভাবছে দলটি। এব্যাপারে স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও চলছে আলাপ-আলোচনা। গ্রুপিং-কোন্দল-বিভেদ ভুলে সবাইকে সরকার পতন আন্দোলনে এক কাতারে আনার পরিকল্পনা হাইকমান্ডের। অলআউট মাঠের আন্দোলনে তাদের কঠোর ভূমিকা দেখতে চায় দলটি। ফিরতে চান বহিষ্কৃত, অব্যাহতি ও পদ-হারানো নেতারাও। তারা বলছেন, মনে গভীর ক্ষত থাকলেও মান-অভিমান ভুলে মাঠের রাজনীতিতে সরব হবেন। তারা কখনো বিএনপির বাইরে যাননি। সব সময় দলের সঙ্গেই থেকেছেন। তবে বহিষ্কার ও অব্যাহতি কারণে সক্রিয় হতে চাইলেও নানা কারণে পারছেন না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনেও অবদান রাখতে চান। দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের পুনর্মূল্যায়ন, দলের শুদ্ধাচারের দাবিও জানান কেউ কেউ।
দলটির নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, নেতাদের দলে ফেরানোর ব্যাপারে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। প্রতিটি কর্মীই দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কাউকেই তারা হারাতে চান না। সবাইকে নিয়েই পথ চলতে চায় বিএনপি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হতেই পারে। এর অর্থ কিন্তু কেউ দল থেকে বাদ গেল বা দল থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া নয়। তাই তাদের দলে ফেরানোর ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চলছে।
সূত্রমতে, চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মেজর (অব.) আক্তারুজ্জামান রঞ্জনকে বহিষ্কার করা হয়। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় বহিষ্কার হন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। তৈমুর আলম খন্দকারের প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামালকেও বহিষ্কার করা হয়। আজীবন বহিষ্কৃত হন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কু। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে গত ২২ জুলাই সাবেক ছাত্রনেতা ও জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ নাসিরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একই অভিযোগে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে। ২০১৯ সালে ছাত্রদলের কমিটিকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছাত্রনেতারা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেন। এতে ১২ জনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়াও নানা সময়ে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা বহিষ্কার হয়েছেন।
জানতে চাইলে পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া নজরুল ইসলাম মঞ্জু নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে বিএনপির রাজনীতি করেছি। দলকে এখনো ভালোবাসি। আমার সঙ্গে সাড়ে পাঁচশ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছিল। তারা গত ১০ মাস ধরে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে দূরে। দলীয় পদ থেকেও আমাদের মূল দাবি ছিল—আন্দোলন-সংগ্রামে পরীক্ষিত-ত্যাগী নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে দল পুনর্গঠন। আর এ কথা বলেই আমরা দলের কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছি। আমরা চাই ভালো মানুষের দল হিসেবে বিএনপি তৈরি করা। পরিচ্ছন্ন ও সময়োপযোগী একটি রাজনৈতিক দল এবং গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপিকে গড়ে তোলা।
বিএনপির এই নেতা বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আগে ২টা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা দরকার। প্রথমে দরকার ঐক্যবদ্ধ বিএনপি। তারপর ঐক্যবদ্ধ জোট। এরপর জনগণকে সম্পৃক্ত করা। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিছিন্নভাবে আন্দোলন করে জয়লাভ করা কঠিন হবে।
নজরুল ইসলাম মঞ্জু আরো বলেন, আমরা চাই- ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ বিষয়ে নজর দেবেন। ইতোমধ্যে তারেক রহমানকে চিঠি দিয়ে আহবান জানিয়েছে দলের ত্যাগী, আন্দোলন-সংগ্রামে পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের পূণর্মূল্যায়ন করার। আশা করি, তারেক রহমান আমাদের কথা শুনবেন। আমাদের দাবিগুলো তদন্ত করে দেখবেন, ব্যবস্থা নেবেন। পাশাপাশি রবিশাল, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট সহ বিভাগীয় শহরের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতৃত্বে নেতাদের মুল্যায়ন ও মর্যাদা দেয়া হোক। দ্বন্দ-বিভেদ অনেক হয়েছে, এখন দায়িত্ব হচ্ছে গনতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটের অধিকার প্রতিষ্টায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা। দল ডাক দিলেই আমরা মাঠে নামতে প্রস্তুত আছি।
কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান নয়া শতাব্দীকে বলেন, বহিষ্কার বা অব্যাহতি দেয়ার আগে চিন্তা করা উচিত। দলে আমাকে ডাকলে ফিরতে প্রস্তুত আছি। তবে এত বারবার বহিষ্কার করাও ঠিক নয়। আমি দলের বাইরের কখনো যাইনি। সব সময় দলের পাশে আছি, আগামীতেও থাকব।
তিনি বলেন, আমার দলের কোনো অবস্থান যদি ভুল হয়, সেটা আমি বলব না? সেটা আমি বলেছি, ভবিষ্যতেও বলব। সে জন্য দল যদি আমাকে আঘাত করে, সে তা করবে। আমাকে যেদিন বহিষ্কার করেছে, সে দিনই আমি আবেদন করেছি।
বহিষ্কৃত বিএনপি চেয়ারপারসনে উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার নয়া শতাব্দীকে বলেন, যে অভিযোগে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে সেটা সঠিক নয়। আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর সবাই বিএনপি রাজনীতি করে। আমাকে যে দিন বহিষ্কার করেছে সেদিনই বলে দিয়েছি, বিএনপির বিপক্ষে আমি কোনো অবস্থান নেব না। তিনি বলেন, আমি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। যেহেতু আমাকে বহিষ্কার করেছে, এ অবস্থায় তো আমি মাঠে-ময়দানে গিয়ে আগের মতো কোনো কর্মসূচিতে যেতে পারি না। নীতিগতভাবে যেতে পারি না।
আজীবন বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র মনিরুল ইসলাম সাক্কু নয়া শতাব্দীকে বলেন, কুমিল্লা সিটির দুই বারের মেয়র ছিলাম। আমি দেখছি এই সিটি বিএনপির হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। শুধু এ কারণে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করেছি। এজন্যই আমাকে দল থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত সঠিক। কিন্তু আমি তো দল ছাড়ি নাই। আমি ৪২ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করি। সুতরাং আমি তো অন্য কোনো দলের রাজনীতি করতে পারি না। ইতোমধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে দলে ফেরার ব্যাপারে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। উনি বলেছেন, বিষয়টা দেখবেন। ইনশাল্লাহ দলে ডাক দিলে আমি ফিরতে উন্মুখ হয়ে আছি।
বহিষ্কৃত নেতাদের ফেরানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমাদের স্থায়ী কমিটিতে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। কমবেশি সবাই পজেটিভ। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ঠিক কবে নাগাদ এই সিদ্ধান্ত আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা একটা সাংগঠনিক বিষয়। তাই এ মুহূর্তে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।
বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, যারা এখনও বিএনপিতে আছেন এবং অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করছেন, তাদের তো অবশ্যই ফিরিয়ে নেয়া হবে। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ