ব্যাংককে চিকিৎসাধীন সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এক ভিডিও বার্তায় বলেন, সারা বিশ্বে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নির্বাচন চলছে। তিনিও ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করবেন। আমাদের দেশে ইভিএমে নির্বাচন হবে, এটা তো নতুন কথা নয়, যখন আমরা ফাইভ-জি ব্যবহার করছি। তাহলে এতে মানা কোথায়। যারা নির্বাচনে জিতে তারা বলে নির্বাচন ফেয়ার হয়েছে, যারা হেরে যায় তখন বলে ফেয়ার হয়নি। অবশ্যই ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করব।
বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর পুরানা পল্টনের ফারর্স হোটেল এক সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদের ধারণ করা ভিডিও বার্তাটি প্রচার করা হয়। এর আগে সংবাদ সম্মেলনে রওশনে পক্ষে তার বক্তব্য পড়ে শোনান বিরোদী দলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব ও জাতীয় পার্টির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসীহ্। এসময় আরো উপস্থিতি ছিলেন কমিটির যুগ্ম অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, জিয়াউল হক মৃধা, ইকবাল হোসেন, কাজী মামুনুর রশীদ, এম এ গোফরান, সদস্য এস এম এম আলম, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর প্রমুখ।
রওশন এরশাদ ব্যাংকক থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ১০ম সম্মেলন আহ্বান করেন আগামী ২৬ নভেম্বর। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই দলে বিতর্ক ও বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
সম্মেলন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে রওশনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য গোলাম মসীহ্ বলেন, কোনো বিভেদ বা বিভ্রান্তি নয়, বেগম রওশন এরশাদের আহবানে জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে আগামী ২৬ নভেম্বরের সম্মেলন ডাকা হয়েছে। দেশবাসির চাওয়া পাওয়া পুরণের লক্ষ্যে রওশন এরশাদের অভিভাবকত্বে নতুন পুরাতন, অবহেলিত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত, বহিষ্কৃত, নিস্ক্রিয় ও অন্য দলে চলে যাওয়া সব নেতাকর্মীদের এক মঞ্চে একত্রিত করে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ডাকা হয়েছে এ সম্মেলন।
গত মাসে ব্যাংককে ধারণ করা এই ভিডিও বার্তায় রওশন এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টি কখনো নির্বাচন বর্জন করে নাই। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে বিশ্বাস করে এবং অংশ নেয়। আগামী নির্বাচনেও আমরা অবশ্যই অংশগ্রহণ করবে। তাই ইভিএম পদ্ধতিতে হলে তাতে অংশ নেবে জাতীয় পার্টি। দেশের জনগণ এখনো জাতীয় পার্টির সঙ্গে আছে এবং ভোট দেবে।
তিনি বলেন, তিনি এখন অনেকটা সুস্থ। পায়ে কিছু সমস্যা রয়েছে। আগামী মাসে (চলতি অক্টোবর) দেশে ফিরবেন। প্রায় ১১ মাস এখানে আছি তবে প্রতিদিন নেতাকর্মীদের সঙ্গে টেলিফোন ও চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ আছে। অনেক কিছুই জানছি। এই কারণেই কাউন্সিল ডেকেছি। বিশেষ করে গত কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করা হয়েছে। অনেকের ক্ষমতা ক্ষর্ব করে দেয়া হয়েছে। যা খুব দুঃখজনক। গঠনতন্ত্রে এমন কিছু ধারা সংযোজন করা হয়েছে, যা দিয়ে একতরফাভাবে দলের নেতাকর্মীদের বহিষ্কার করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর দল অনেকটা দুর্বল এবং এলোমেলো হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ করে বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, দলকে শক্তভাবে দাঁড় করাতে হবে, বহিষ্কৃত এবং নিস্ক্রিয়দের দলে সক্রিয় করতে হবে, যাতে আগামী নির্বাচনটা ভালোভাবে করতে পারি।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় পার্টির দুর্দিনে যেসব নেতাকর্মীরা প্রায়ত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে আগলে রেখে দলকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, আজ তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আগামী কাউন্সিলে সকল নেতাকর্মীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে রওশন এরশাদ বলেন, অতীতে যার জাতীয় পার্টির জন্য, পল্লীবন্ধু এরশাদের জন্য জেল-জুলুম অত্যাচর সহ্য করেছে, তাদেরকে আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি এবং তারা যদি সবাই আবার সক্রিয় হন, তাহলে পার্টি আরো বেশি শক্তিশালী হবে। কাজেই আবার সবাই মিলে সক্রিয় হলে জাতীয় পার্টিকে নিশ্চয়ই আমরা একটা ভাল জায়গায় নিয়ে যেতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
বিরোধী দলীয় এই নেতা আরো বলেন, আমি জানি, নির্বাচন দেয়া হবে, ভালো নির্বাচন হবে এবং দেশটা এগিয়ে যাওয়ার জন্য তারা কাজ করবে যারা জিতে আসবে। দেশবাসী নিশ্চয়ই ভালো থাকবে নির্বাচনে। ইনশাআল্লাহ ভালো ফলাফলই হবে।
সংবাদ সম্মেলনে রওশনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য গোলাম মসীহ্ বলেন, আমরা পরিবর্তন, ষড়যন্ত্র এবং চ্যালেঞ্জের অনুভব করেছি। আমরা এখনো দাঁড়িয়ে আছি। একটি সুন্দর গাছের শিকড়ের মতো। দুর্দিনে আমাদের নিবেদিত প্রাণ ও পরীক্ষিত কর্মীরাই আমাদের শক্তি। দুর্নীতিসহ সব ধরনের শোষণমুক্ত নতুন বাংলাদেশের আদর্শে বিশ্বাসী আমরা।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ইতিবাচক এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। বিশ্বাস করুন সবকিছু সম্ভব এবং আমরা ক্ষমতায় যাব। সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব দ্বারা নতুন প্রজন্মের কাছে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে থাকবে জাতীয় পার্টি। আমরা এই যুদ্ধে জিতব এবং চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠব। জাতীয় পার্টি আরো শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশে চিরকাল বেঁচে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
গোলাম মসীহ্ আরো বলেন, ২৬ নভেম্বরের দশম জাতীয় সম্মেলন ও বিভিন্ন সময় তার দেয়া বক্তব্য নিয়ে গণমাধ্যমে নানা রকম সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাঙ্খিত নয়। স্যোশাল মিডিয়ায় নানাভাবে রওশন এরশাদ ও পল্লীবন্ধুপুত্র সাদ এরশাদকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ট্রল করা হয়েছে, পার্টি ও দলের বাইরে অনেক কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ও মন্তব্য করেছেন, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে গালাম মসীহ্ বলেন, জিএম কাদের বলে বেড়াচ্ছেন বেগম রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির কেউ নয়। এ কথা ঠিক নয়। তিনি দলের এক নম্বর প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সংসদীয় দলের নেতৃত্ব দেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টি ভাঙনের মুখে ফেলতে চান না। সবাইকে নিয়ে পার্টিকে শক্তিশালী করতে চান তিনি।
বিশেষ মহলের হস্তক্ষেপে রওশন এরশাদ হঠাৎ করে দলকে বিভক্ত করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম মসীহ বলেন, কোনো বিশেষ মহল এখানে নেই। এই বিশেষ মহল কারা, তা আমরা জানি না।
সংবাদ সম্মেলনে কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অসুস্থতার সুযোগে রাতে অন্ধকারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন জিএম কাদের। তার নেতৃত্বেই নবম জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল ২৮ ডিসেম্বর। তবে ২৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বর্তমান চেয়ারম্যান, মহাসচিব বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছিল, সেখানে রুল জারি পরও একটা প্রশ্নবিদ সম্মেলন করেছিল তারা। তাই জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বেগম রওশন এরশাদ সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নেতাকর্মীদের একত্রিত করে জাতীয় কাউন্সিলের ডাক দিয়েছেন। এই সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে যোগ্য নেতা নির্বাচিত হবেন।
তিনি আরো বলেন, বেগম রওশন এরশাদ বলেছেন, আমার কোন নেতা হওয়ার ইচ্ছা নেই। যদি সারাদেশের নেতৃবৃন্দ মনে করেন, তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হবে তাহলেই শুধুমাত্র দায়িত্ব নেবেন। জিএম কাদেরকে যোগ্য মনে করলে তিনি চেয়ারম্যান হবেন। এখানে কারো কোন আপত্তি থাকবে না। তবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবারের সম্মেলন ডেকেছেন ম্যাডাম।
কাউন্সিল সর্ম্পকে কিছুই জানে না জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চন্নু এক প্রশ্নের জবাবে কাজী মামুন বলেন, বর্তমান মহাসচিব কাউন্সিলের মাধ্যমে আসে নাই। সম্মেলনে মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিল মসিউর রহমান রাঁঙ্গা। সুতবাং ২০ এর ১ (ক) ধারা অনুযায়ী জিএম কাদের কর্তৃক নিয়োজিত হয়েছেন। মুলত অগণতান্ত্রিক ধারায় তিনি মহাসচিব হয়েছেন। তাই তার বক্তব্য জাতীয় পার্টির কোন বক্তব্য নয়, ব্যক্তি জিএম কাদেরের বক্তব্য।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ