দুই মাস ধরে রাজধানীসহ সারাদেশের রাজপথে সরকারবিরোধী কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এতে দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকের কোনো বাধা ছাড়াই সভা-সমাবেশে অংশ নিয়েছে। কিন্তু বিএনপির এই কর্মসূচির ধারা অব্যাহত থাকলে দলটির কর্মীরা নিজেদের শক্তিশালী ভাবতে শুরু করবে। তারা বাধা উপেক্ষা করে পাল্টা হামলায় জড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
দলটি বলছে, বিএনপির চলমান কর্মসূচি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কোনো আন্দোলন বা কর্মসূচি নয়। কারণ সমাবেশে বাঁশের লাঠি নিয়ে যাচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাস, নাশকতা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে দলটি মাঠে নেমেছে। এমতাবস্থায় বিএনপির মাঠের আন্দোলন থামাতে আরও কঠোর হচ্ছে সরকারি দল। মাঠেও কঠোর অবস্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই সরকারবিরোধীদের কীভাবে মাঠছাড়া করা যায় সেই উপায় খুঁজছে আওয়ামী লীগ। দলীয় সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
এদিকে বিএনপি তাদের চলমান আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলন বলে ঘোষণা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন বিএনপির নেতারা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকার একাধিক সমাবেশে বিএনপির কর্মীরা লাঠি নিয়ে এসেছেন। জড়িয়েছেন সংঘর্ষেও। বিএনপি আন্দোলনের নামে সহিংসতা করতে চাইছে, সেটা প্রমাণ করতে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে আওয়ামী লীগের। তাই বিএনপির কর্মীদের লাঠি নিয়ে সমাবেশে আসার বিষয়টি সামনে আনা হবে। তাতে ‘সহিংসতা’ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুরোমাত্রায় বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।
অবশ্য এও বলছেন ওই সব নেতা, এছাড়াও বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে থাকা পুরোনো মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার দ্রুত শেষ করার চেষ্টা থাকবে। পাশাপাশি নতুন মামলায় গ্রেফতার-আতঙ্ক ছড়ানো হবে, যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপি আন্দোলন টেনে নিতে না পারে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা এও মনে করছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ ‘নেয়া না নেয়া’ নিয়ে বিএনপির ভেতরেও শুরু হতে পারে ভাঙা-গড়া। কারণ বিএনপির একটি অংশ চাইছে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে।
দলীয় সূত্রমতে, ঢাকার বাইরে বিএনপিকে কর্মসূচি পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি নির্দেশনা আছে। ঢাকায় সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে বিএনপিকে চাপে রাখা হচ্ছে। তবে সব কর্মসূচির ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হচ্ছে না। কোথাও ছাড়, কোথাও বাধা দেয়ার কৌশল নেয়া হয়েছে। তবে ঢাকার আশপাশের কর্মসূচির ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি কঠোরতা দেখানো হচ্ছে। পুলিশকে গুলিও করতে হয়েছে। এরপরও বিএনপি কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।
পর্যায়ক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করার চেষ্টার চিন্তা রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, বিএনপির কর্মসূচি থামাতে দলের নেতাকর্মী ও পুলিশকে সুবিধামতো কাজে লাগানো হচ্ছে। এতে সরকার সমালোচনায় পড়ছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছেন। তাই বিএনপিকে সহিংসতার দায় দিয়ে চাপে ফেলা সবচেয়ে সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিএনপি সহিংস হওয়ার পর তাদের দমন করা সহজ হয়েছিল।
বিএনপি গত আগস্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি দিয়ে আসছে। বিএনপি বলছে, গত ১ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে সরকারি দল ও পুলিশের হামলায় বিএনপির পাঁচ নেতাকর্মী নিহত। এরমধ্যে চারজন পুলিশের গুলিতে এবং আওয়ামী লীগের হামলায় নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২ হাজার ৭৬৮ জন। গ্রেফতার করা হয়েছে ২৯৪ জনকে। মামলা করা হয়েছে ৭৫টি। এসব মামলায় মোট আসামি প্রায় ২৫ হাজার। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ৫ হাজার ৪৭০ নেতাকর্মী। এরই মধ্যে নতুন করে তিন মাসব্যাপী নতুন কর্মসূচিও দিয়েছে বিএনপি। তিন মাসব্যাপী এ কর্মসূচি শেষ হবে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে। দলটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি টেনে নিতে চায়।
জানা যায়, গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগে বিএনপির সমাবেশে বাঁশ ও কাঠের ছোট ছোট লাঠি নিয়ে নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। কোনো কোনো লাঠির মাথায় ছিল ছোট আকারের জাতীয় পতাকা। তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসেন। এ সময় লাঠিসোঁটা নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় নামলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে দুই পক্ষেরই বেশ কয়েকজন আহত হয়। একপর্যায়ে পুলিশ দুই পক্ষের মাঝে অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
এ ঘটনার পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। যার ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় গত ২৮ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে। ওই সভায় বিএনপির এসব তৎপরতা এখনই প্রতিহত করতে মাঠে নামার দাবি জানান ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতা।
ওই আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বিএনপির উদ্দেশে বলেন, এখনও আমরা রাস্তায় নামি নাই, রাস্তায় নামলে দেখবেন। পুলিশের ওপর, আমাদের কর্মীদের ওপর, সাংবাদিকদের ওপর হামলা করছেন। কী পেয়েছেন? আমরা মুক্তিযুদ্ধের দল, এই রাজাকারদের আমরা রাজপথে হাঁটতে দিতে পারি না।
হাজারীবাগের সংঘর্ষে আহত কর্মীদের দেখতে গত শুক্রবার পঙ্গু হাসপাতালে যান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকা নেতার্মীদের দেখতে যান নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক শুক্রবার আহত নেতাকর্মীদের দেখতে গিয়ে বলেন, একটা সহ্যের সীমা আছে। সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেলে পরিণতি ভালো হবে না। দলগতভাবে বিএনপিকে মোকাবিলা করা হবে। হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
দলীয় সূত্র জানায়, একদিকে বিএনপির আন্দোলনের চাপ বেড়েছে। অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও প্রকট। আগামী জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে তৃণমূলেও সম্মেলন চলছে। এতে বিভিন্ন স্থানেই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতিতে শুধু দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে বিএনপিকে চাপে রাখা যাবে কিনা এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে দলের নীতিনির্ধারকরা। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কীভাবে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা যায় সেই উপায় খুঁজছে দল।
আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বিএনপি একদিকে সরকারবিরোধী সব দলকে এক কাতারে আনার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে সমাবেশের মাধ্যমে দলকে সংগঠিত করছে। আগের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা আছে। এবার বিএনপিকে মাঠে নামার সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি কীভাবে মাঠছাড়া করা যায়, সেই পরিকল্পনাও চলছে।
এবিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, এটাকে কোনোভাবেই আন্দোলন বলা যাবে না। সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা করছে বিএনপি। হাজারীবাগে পুলিশ, আওয়ামী লীগের কর্মী, সাংবাদিকদের ওপর পর্যন্ত তারা সন্ত্রাসী হামলা করেছে। আমাদের দলের তিন কর্মীকে তারা মারাত্মকভাবে আহত করেছে। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। দাবি করে বলেন, আওয়ামী লীগ মারামারি করছে না। বিএনপি সহিংসতার পথে যাচ্ছে। সেটা জনগণের কাছে উন্মোচন করবে আওয়ামী লীগ।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি তাদের অতীতের চেনামুখ সন্ত্রাসীদের মাঠে নামিয়েছে, সারাদেশ থেকে ঢাকায় এনেছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, নাশকতা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করা, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। এই সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে আওয়ামী লীগ, সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণকে নিয়ে মাঠে থাকব আমরা। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি তাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করবে। তাদের কর্মসূচি অহিংস হলে সমস্যা নেই। তারা এর মধ্যে অনেক কর্মসূচি পালনও করেছে। কিন্তু তারা যেভাবে এখন লাঠি নিয়ে মাঠে নামছে, তাতে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার ষড়যন্ত্র দেখা যাচ্ছে। এটা মেনে নেয়া হবে না। নিশ্চয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি দেখবে।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ