জাতীয় পার্টি (জাপা) নিয়ে বিতর্ক যেন থামছেই না। বরং আগের চেয়ে তা আরও দৃঢ় হচ্ছে। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য। বহিষ্কার, অব্যাহতি, কমিটি গঠন, দলে ফেরাতে পাল্টাপাল্টি চলছেই। এককভাবে দলের নিয়ন্ত্রণ নিতেও চলছে কথার লড়াই।
দুই শীর্ষ নেতার এই দ্বন্দ্বকে ভালোভাবে দেখছে না দলের অনেক নেতাকর্মী। এই বিরোধ-বিবাদ যে অনেকদূর গড়াবে তা রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠদের কথাবার্তাও প্রকাশ পাচ্ছে। এর মধ্যে রওশনের দেয়া একটি চিঠি দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
সম্প্রতি জি এম কাদেরকে ‘আদেশ-নির্দেশ’ দিয়ে অব্যাহতি দেয়া নেতাদের দলে ফেরানোবিষয়ক একটি চিঠি দেন রওশন এরশাদ। আর তাতেই গা জ্বলে ওঠে দলটির বর্তমান চেয়ারম্যানের।
রওশনপন্থিরা বলছেন, এ চিঠি রওশন এরশাদের নির্দেশে প্রস্তুত করা হয় এবং তিনিই স্বাক্ষর করেন। যারা রওশনের বিরোধিতা করছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। নভেম্বরে রওশনের নেতৃত্বে বিশেষ কাউন্সিল করার কথাও জানান তারা।
অপরদিকে, জি এম কাদেরপন্থিরা রওশনের চিঠিকে অবিশ্বাস করছেন। তারা বলছেন, রওশনকে জিম্মি করে ব্যাঙ্ককে বসে এসব করা হচ্ছে। এ অবস্থায় কয়েক নেতাকে অব্যাহতি দেয়া হতে পারে বলেও আভাস দিয়েছেন দলের একাধিক নেতা। জি এম কাদের ও দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই বলছেন, রওশন এরশাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় জিম্মি হয়ে আছেন জাতীয় পার্টির কয়েক নেতার হাতে। তাদের সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডকে ভালো চোখে দেখছে না দল। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে অব্যাহতিও দেয়া হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
অসুস্থ রওশন এরশাদের সঙ্গে ব্যাঙ্ককে থাকা এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য কাজী মামুনুর রশিদ গত শুক্রবার দেশে ফিরেছেন। তিনি জানান, রওশন এরশাদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তিনি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশে ফিরবেন। যারা রওশন এরশাদের পাঠানো চিঠি ও বিবৃতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এরশাদ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বাজে কথা বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন রওশন এরশাদ।
রওশনের চিঠি নিয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর সন্দেহ প্রকাশ বিষয়ে কাজী মামুনুর রশিদ বলেন, চুন্নু কে? সে এরশাদ পরিবারের বিষয়ে কথা বলার কে? এসব তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বলছে। তারা এত কথা বলছে, কিন্তু ১১ মাস ধরে রওশন এরশাদ অসুস্থ, তারা দেখতে আসেনি কেন? রওশন এরশাদ ঢাকায়ও তাদের ডেকেছিলেন, কিন্তু তারা আসেননি কেন?
মামুনুর রশিদ আরও বলেন, রওশন এরশাদের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২৬ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। ওই কাউন্সিলে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। রওশনের ডাকা কাউন্সিল ও চিঠি নিয়ে সন্দেহ পোষণকারীদের বিরুদ্ধে রওশনের ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমার কোনো কমেন্ট নেই।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রওশনের চিঠির বিষয়ে মুজিবল হক চুন্নু বলেছিলেন, জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ পার্টির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় কিছু করছেন বলে বিশ্বাস করি না। তবে রওশন এরশাদ তার ছেলে সাদ এরশাদ ও আরও দু’একজনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। বেগম রওশন এরশাদের যে চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেই চিঠি আমরা আমলেই নিচ্ছি না।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টিতে কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাকে সম্প্রতি দলের সব পদপদবি থেকে অব্যাহতি দেয়া এবং পরবর্তীতে দলীয় চেয়ারম্যানের বিরোধিতা করে রাঙ্গার সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জাপার ভেতরের অন্তর্দাহ-কলহ প্রকাশ্য রূপ নেয়। রাঙ্গার পর অব্যাহতি দেয়া হয় অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধাকে।
এছাড়া রওশন এরশাদের বদলে জি এম কাদেরকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর দলীয় সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে গত এক মাস ধরে বিদেশে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদের নামে বিভিন্ন বিবৃতি বা চিঠিপত্র আসায় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে রওশন ও জি এম কাদের শিবিরের দূরত্ব।
তবে রওশন এরশাদ এসব বিবৃতি স্বেচ্ছায় দিচ্ছেন না বলে মনে করছেন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেন, রওশন এরশাদ অসুস্থ। তার চিকিৎসা চলছে। অসুস্থতা ও বয়স সবকিছু মিলিয়ে ঠিকভাবে বাছবিচার করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো শারীরিক অবস্থানে তিনি নেই। কোথায়, কী কাগজে স্বাক্ষর করছেন সেটিও হয়তো তিনি বুঝতে পারছেন না। সেই সুযোগে একটি চক্র নিজেদের মতো করে সাজানো চিঠিতে তার স্বাক্ষর নিচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি।
সম্প্রতি রওশন এরশাদের নামে প্রায় এক মাসে অন্তত ৩০টি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও বিবৃতি এসেছে গণ্যমাধ্যমে। তাতে স্বাক্ষরকারী সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব ও রওশনের ডাকা জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসীহ্।
তিনি বলেন, রওশন এরশাদ নিজেই ওইসব চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। তিনি নিজেই এসব চিঠি প্রস্তুত করতেও বলেছেন। তিনি চিঠিতে স্বাক্ষর করছেন এমন ভিডিও রয়েছে। তাকে কেউ জিম্মি করেনি।
যদিও রওশনের নামে পাঠানো বিবৃতি নিয়ে সন্দেহ দূর করতে প্রমাণস্বরূপ বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের প্রেস উইং থেকে একটি ছবিও পাঠানো হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে। যাতে দেখা যায়, হাসপাতালের বেডে রওশন এরশাদ কাগজপত্র পড়ছেন এবং কলম হাতে স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রওশন এরশাদ টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে-বিদেশে চিকিৎসাধীন।
রওশনের ফোন না ধরা নিয়ে গোলাম মসীহ্ বলেন, কেউ যোগাযোগই করছে না। তিনি সবার ফোন ধরেন। তবে মন্তব্যের জন্য একাধিকবার রওশন এরশাদকে ফোন করলেও তার ব্যবহূত মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
অবশ্য জি এম কাদেরের অনুসারীদের দাবি, রওশন এরশাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় জিম্মি হয়ে রয়েছেন জাতীয় পার্টির কয়েক নেতার হাতে। এমনকি রওশন এরশাদের মোবাইল ফোনটিও আরেকজনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। রওশনকে সারক্ষণ পাহারা দেয়া হচ্ছে, যেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে কাউকে কিছু না বলতে পারেন। তারা রওশনের নামে প্রকাশ হওয়া বিবৃতিগুলো অবিশ্বাস করছেন। সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করছেন বিবৃতির সত্যতা নিয়ে।
তবে এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মামুনর রশিদ এর প্রতিবাদ করে বলেন, যারা সন্দেহ করছে, তাদের জন্ম নিয়েও সন্দেহ আছে। রওশন এরশাদ নিজেই দলকে সুসংগঠিত করতে এসব বিবৃতি, চিঠি দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জি এম কাদের বলেন, রওশন এরশাদ অসুস্থ। চিকিৎসা চলছে। সবকিছু মিলিয়ে ঠিকভাবে বাছবিচার করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো শারীরিক অবস্থানে তিনি নেই। এই সুযোগে একটি চক্র নিজেদের মতো করে কিছু একটা লিখে নিয়ে তার স্বাক্ষর নিচ্ছেন বলে মনে করছেন তিনি।
গত একমাস ধরেই বিবৃতিতে সরব দেখা গেছে রওশন এরশাদকে। সবশেষ ২১ সেপ্টেম্বর রওশনের নামে গোলাম মসীহ্ স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জাপা থেকে অব্যাহতি, বহিষ্কার এবং কমিটি থেকে বাদ দেয়া সবাইকে দলে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে ‘আদেশ’ দিয়েছেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জি এম কাদেরের কাছে পাঠানো নির্দেশনামূলক এক চিঠিতে তিনি এ আদেশ দেন। চিঠিতে জাপার গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার কয়েকটি উপধারাকে ‘গণতন্ত্রপরিপন্থি ও স্বেচ্ছাচারমূলক’ আখ্যা দিয়ে সেগুলো স্থগিতেরও ‘নির্দেশ’ দেন রওশন।
যেসব নেতাকে দলে ফিরিয়ে নিতে রওশন বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন তারা হলেন, সদ্য অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান (রাঙ্গা) ও সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা, এর আগে দল থেকে বাদ পড়া সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল গাফফার বিশ্বাস, এম এ সাত্তার, দেলোয়ার হোসেন খান, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, কাজী মামুনুর রশিদ ও ইকবাল হোসেন, সাবেক উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম নুরু।
বিজ্ঞপ্তিতে রওশন এরশাদ বলেন, এদেরসহ দেশজুড়ে অব্যাহতিপ্রাপ্ত, বহিষ্কার ও নিষ্ক্রিয় করে রাখা সব নেতাকর্মীকে এই আদেশ জারির পর হতে যার যার আগের পদ-পদবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ