ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফের ভাঙনের মুখে জাতীয় পার্টি 

প্রকাশনার সময়: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৫৫

জাতীয় পার্টিতে (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের দ্বন্দ্ব ফের চরমে উঠেছে। দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বের জেরে ফের ভাঙনের মুখে পড়তে পারে দলটি। রওশনের তরফে আচমকা দলের কাউন্সিল ডাকা, অন্যদিকে রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দিতে এমপিদের চিঠি, গ্রুপিং এবং আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের অবস্থান— এসব কেন্দ্র করেই আবার দুই পক্ষই সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতৃত্ব নিয়েই জিএম কাদের ও রওশান এরশাদের বলয়ের অন্তঃকলহ ও দূরত্ব প্রতিদিনই বেড়ে চলছে। এছাড়াও দলের অভ্যন্তরে বিদ্যমান গ্রুপিং আবারো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। তবে এটি দলের মধ্যে ভাঙন ধরাবে কিনা তা দেখতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন জাপার নেতাকর্মীরা।

সাম্প্রতিক টানাপড়েন প্রশ্নে জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, দলে কোণঠাসা হয়ে জি এম কাদেরবিরোধীরা রওশন এরশাদকে ভুল বুঝিয়েছেন। এরমধ্য দিয়ে দলে নিজেদের আবারো প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন রওশনপন্থিরা। জি এম কাদেরপন্থিরা এদের সুবিধাবাদী বলেই আখ্যায়িত করছেন। দলটি আবার ভাঙবে কিনা, সে প্রশ্ন নতুন করে উঁকি দিলেও নেতারা অবশ্য বলছেন, দল এখন আগের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ, দল শক্তিশালী।

এদিকে, দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জকারী অংশটি আগামী কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এই অংশটিকে তৃতীয় শক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। চেয়ারম্যানপন্থি নেতারা বলছেন, যদি রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দল আবার ভাঙে তাতেও মূল দলের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ জাতীয় পার্টির মূল দল এখন জি এম কাদেরের সঙ্গেই আছে। মুল দলের যারা রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগ দিবেন তাদের দল থেকে বহিষ্কার হবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে জিএম কাদেরের আচার-আচরণ সন্দেহজনক হয়ে উঠছে। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু করেছেন নানামুখী তৎপরতা। আওয়ামী লীগ জোটে, না বিএনপি জোটে যোগ দিবেন এই নিয়ে অবিশ্বাস ও সন্দেহ দানা বাঁধছে।

সম্প্রতি বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলের বিয়েতে অংশ নিয়ে জিএম কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও ভিডিও কলে কথা হয়েছে। তারেক রহমান আগামী নির্বাচনে বিএনপির জোটে থেকে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন।

প্রস্তাবে অনেকটা রাজি হয়ে ১০০ আসন, ৮ মন্ত্রণালয় ও ডেপুটি স্পিকারের পদ চেয়েছেন দলের চেয়ারম্যান। তাই আগামী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ভিড়ে যেতে পারেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে— এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে দলে তিনটি গ্রুপ সক্রিয়। এক গ্রুপের নেতৃত্বে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক। অন্য গ্রুপে বেগম রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা। অপর গ্রুপে এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের। দলের এই হ-য-ব-র-ল অবস্থায় সারাদেশের নেতাকর্মীরা হতাশাগ্রস্ত। তাদের প্রশ্ন, জাতীয় পার্টি কোন পথে যাচ্ছে। দলটির ভবিষ্যৎ কি একেবারেই অন্ধকার? এমন প্রশ্ন নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে পকেট বৈঠক এবং কানাঘুষা।

অপরদিকে, বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার তৎপরতার খবরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন রওশন এরশাদ। তার সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এমপিদের এমন সিদ্ধান্ত তিনি মানতে পারেননি। এ জন্য রওশনপন্থিরাও জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের উপনেতার পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য স্পিকারকে দিতে একটি চিঠি তৈরি করেছেন। রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ চিঠি লিখে থাইল্যান্ডে পাঠিয়েছেন। তবে এখনো এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আলমগীর শিকদার লোটন বলেন, মূল দল জি এম কাদেরের নেতৃত্বেই ঐক্যবদ্ধ আছে। তার নেতৃত্বে পুরো দল আছে। যদি উনারা (রওশনপন্থিরা) কাউন্সিলও করেন, তাতেও মূল দলের কোনো ক্ষতি হবে না।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, রওশন এরশাদ ঠিক কাজ করছেন না। এটা আমাদের জন্য অনেক দুঃখজনক ও আপত্তিকর। আমরা কেন দুই ভাগে ভাগ হতে যাব? এটা তো আমরা রওশন এরশাদের কাছে আশা করি না।

কাউন্সিল হলে জাতীয় পার্টি আবার ভাঙবে কিনা, জানতে চাইলে আলমগীর শিকদার বলেন, এটা জানতে কিছুদিন সময় লাগবে। তবে আমি মনে করি, ওই পর্যন্ত তারা যেতে পারবে না।

রওশন এরশাদের সঙ্গে কারা আছেন জানতে চাইলে এই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, যারা পরিশ্রম ছাড়াই দলের এমপি হতে চান, তারাই এখন রওশন এরশাদের সঙ্গে এসে জুটেছেন। সুযোগসন্ধানী লোকগুলো রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলকে ভাঙতে চায়। এরা দালালি পছন্দ করেন, এরা তাই করছেন।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে জাপায় দুটি বলয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে একাংশের নেতৃত্ব দিতে থাকেন রওশন এরশাদ। তবে দলের নেতৃত্ব এরশাদ তার ভাই জি এম কাদেরকে দিয়ে যান। এরপর তিনি রওশনকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক করেন। পাশাপাশি তিনি জাতীয় সংসদে হন বিরোধীদলীয় উপনেতা। সে সময় জি এম কাদের ও রওশনের মধ্যে যে মীমাংসা হয়, সে অনুসারেই সবকিছু চলছিল।

তবে সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে গিয়ে দলের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট হন রওশন এরশাদ। জি এম কাদের এবং তার অনুসারীরা তার খোঁজ না নেয়ায় গত ২ জুলাই দলের একটি মতবিনিময় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন রওশন। এই সভায় দলে ইতিমধ্যে কোণঠাসা নেতারা উপস্থিত থাকলেও জাতীয় পার্টির মূল দলের কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

অবশ্য জাতীয় পার্টির নেতারা এও বলছেন, রওশনের এই অসন্তোষের সুযোগ নিচ্ছেন জাতীয় পার্টির কেউ কেউ, যাদের একটি অংশ একসময় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য হলেও আগামীতে তাদের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জানতে চাইলে জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘রওশন এরশাদকে উল্টো বুঝিয়ে তৃতীয় একটি পক্ষ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে, যা আমাদের দলের চেয়ারম্যানও বলেছেন। কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারবে না। তৃতীয় পক্ষ বলতে কাকে বোঝানো হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা ওনার (রওশন) পাশেই থাকেন। উনি দেশে এসে হোটেল ওয়েস্টিনে যে সভা করছিলেন, সেই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, তারাই হলেন সেই তৃতীয় পক্ষ।

এ বিষয়ে জি এম কাদের বিরোধী হিসেবে পরিচিত দলের সাবেক সংসদ সদস্য প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, আমি রওশন এরশাদের সঙ্গে আছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনি গোলাম মসিহ কিংবা কাজী মামুনুর রশিদের সঙ্গে কথা বলেন।

জি এম কাদের বিরোধী হিসেবে পরিচিত ও এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদ বলেন, কোনোভাবেই জি এম কাদেরের সঙ্গে কোনো মীমাংসা হবে না। শুধু যদি তিনি (জি এম কাদের) রওশন এরশাদের নেতৃত্ব মেনে নেন, তাহলেই মীমাংসা হওয়া সম্ভব। তিনি আরো বলেন, ম্যাডাম (রওশন) যদি মীমাংসায় রাজি হন, তাহলে হবে, কিন্তু জি এম কাদেরের নেতৃত্বে কোনো মীমাংসা হবে না। দাবি করেন, আপনাদের যে গঠনতন্ত্র দেয়া হয়েছে, সেটা আসলে দলের আসল গঠনতন্ত্র নয়। গঠনতন্ত্র যেটা কাউন্সিলে পাস হয়েছে, সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে সর্বময় ক্ষমতা রওশন এরশাদের। যে গঠনতন্ত্র আপনারা পেয়েছেন, সেটা হলো জি এম কাদেরের বানানো গঠনতন্ত্র।

‘দলবিরোধী ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ তোলা হচ্ছে উল্লেখ করা হলে কাজী মামুনুর রশিদ বলেন, আপনারা অপেক্ষা করেন। দেখেন কার সঙ্গে কে থাকে। কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিয়ে মামুনুর রশিদ বলেন, আমরা সম্মেলনের একটি অংশবিশেষ আজকে পেয়েছি। বাকি অংশটি বিরোধীদলীয় নেতার (রওশন) অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এরপর সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির একটি সভা করব। আমরা মনে করি, রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন একজন। তিনি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী। প্রতিষ্ঠাকালীনও তার অনেক শ্রম ছিল।

জাতীয় পার্টিতে আগের যত ভাঙন: সেনাপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা দখল করে এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১৯৮৬ সালের পহেলা জানুয়ারি গঠন করেন জাতীয় পার্টি। ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় জাতীয় পার্টি ভাঙনের কবলে পড়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে। দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে জাতীয় পার্টি (জেপি) গঠন করেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। বর্তমানে তিনি সাংসদ হিসেবে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় ভাঙনের শিকার হয় নাজিউর রহমানের নেতৃত্ব। তখন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) গঠন করে। এখন বিজেপির প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। ২০১৪ সালে প্রয়াত কাজী জাফর আহমদের হাত ধরে ভাঙনের শিকার হয়েছে। এ সময় জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) একাংশ গঠন করেন। তিনি এরশাদের জীবদ্দশায় জাতীয় পার্টি তিন দফায় ভেঙেছে। তার মৃত্যুর ২ বছরের মাথায় আবারও ভাঙনের মুখে পড়ল দলটি। তিনটি দলই লাঙল প্রতীক ব্যবহার করছে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ