দীর্ঘ ১৬ বছরে ক্ষমতার বাইরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ৪৫তম বর্ষে পা দিচ্ছে আজ। ৪৪ বছর অতিক্রম করা দলটি এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর বর্তমানে কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বিশেষ করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়। এটাই এই মুহূর্তে দলটির একমাত্র মূল লক্ষ্য। দাবির পক্ষে কর্মী-সর্মথক বাড়াতে তৃণমূল চষে বেড়াচ্ছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। এবার দাবি আদায় করেই ঘরে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। দলটির নেতারা বলছেন, নানা প্রতিবন্ধকতায়ও অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি এখন বেশি শক্তিশালী। দলের প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখের বেশির মামলা ঝুলছে। দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে অর্ধশত মামলা রয়েছে। এছাড়াও দলের এমন কোনো নেতা পাওয়া যাবে না তার নামে মামলা নেই। জেল-হেফাজতে মারা গেছেন সহস্রাধিক, আর গুম হয়েছেন ছয় শতাধিক নেতাকর্মী। তারপরও বিএনপি সাংগঠনিকভাবেই টিকে আছে। দলটি ভাঙেনি। উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা অন্য দলে যোগ দেননি। মামলায় জর্জরিত হয়েও দলের নেতাকর্মীরা মাঠ ছাড়েননি। কারণ দলের নেতাকর্মীরা কঠিন সময়েও জিয়ার আদর্শ-দর্শন লালন করে চলেছেন।
তারা আরো বলেন, সামনে মূল চ্যালেঞ্জ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সংলাপ করা দলগুলোকেও একযোগে মাঠে নামানো। দাবি আদায়ে ক্ষমতাসীনদের রাজপথেই মোকাবিলা করা হবে। আগামী নির্বাচন ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি।
খালেদা জিয়ার দুই মামলায় সাজা হওয়ার তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকটাই অনিশ্চিত। বর্তমানে শর্ত-সাপেক্ষে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্ত হয়ে গুলশানের ফিরোজায় আছেন। নানা অসুখ-বিসুখে দিন কাটে তার। অন্যদিকে অর্ধশত মামলা মাথায় নিয়ে ‘পলাতক’ অবস্থায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অবস্থান করছেন লন্ডনে। এর মধ্যে তিন মামলার সাজা হয়েছে। একটিতে যাবজ্জীবন দণ্ড। তারও দেশে ফিরে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া কঠিন। অবশ্য লন্ডন থেকেই তিনি এখন ভার্চুয়ালে দলের হাল ধরার চেষ্টা করছেন। তাদের দুইজনের বিকল্প নেতাও সামনে নেই। নানা সংকটের মধ্যেও দলের ঐক্য অটুট রাখার চেষ্টা করছে। আগামী দিনের আন্দোলন সংগ্রামকে সামনে রেখে নেতাকর্মীদের চাঙা করতেই অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো এবং তৃণমূলের কমিটি ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এছাড়া দেশ-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রর কাছে বারবার হার মেনেছে বিএনপি। এমন অবস্থায় আসছে নির্বাচনের আগেই বেশ কটি চ্যালেঞ্জের মুখে দলটি। তবে শীর্ষ নেতারা বলছেন, সরকারের নির্যাতন-পীড়ন উপেক্ষা করে বিএনপি জনগণের কথা বলে যাচ্ছে— এখানেই সার্থকতা। তৃণমূলের কর্মসূচিতে জনস্রোত দেখে সরকার ভীত হয়ে দমননীতি শুরু করেছে। এখন নতুন সংযোজন হয়েছে নেতাদের বাসাবাড়ি-ঘরে হামলা।
এ অবস্থায় গত ২২ আগস্ট থেকে মহানগর-জেলা-উপজেলায় চলছে কর্মসূচি। টানা এ কর্মসূচি চলবে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এসব কর্মসূচিতে কোথাও কোথাও না সংঘাত সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীরাও উজ্জীবিত। তারা বলছেন, হামলা-মামলার শিকার হলেও রাজপথে থাকার অবস্থানে অনড় রয়েছেন তারা। দাবি আদায় করেই এবার ঘরে ফিরব। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষেও দলের পক্ষ থেকে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭৮ সালে রমনা গ্রিনের সবুজ চত্বরে জিয়াউর রহমান বিএনপির পতাকা ওড়ান। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের মানুষকে একমঞ্চে এনে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’ গঠন করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৩ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের মাধ্যমে তোপের মুখে পড়ে বিএনপি। বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে ৩৫ লাখ মামলা মোকাবিলা করার চেষ্টা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও পাহাড়সমান মামলা নিয়ে নেতাকর্মীরা নির্বাচনি মাঠে অংশ নিতে পারেননি। এ জন্য ফল বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। বিএনপি মনে করে, নিরপেক্ষ নির্বাচন না হওয়ায়, তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি হয়রানি হওয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভালো করতে পারেনি দল।
দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমানে দলটির বড় চ্যালেঞ্জ হলো ঐক্য ধরে রাখা। ২০২৩ সালে একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করা। এর আগে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য জনমত তৈরি করা। দাবি আদায়ে ইতিমধ্যে সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে দায়িত্বশীল নেতারা। সরকার পতনে আন্দোলনে সব দলই ‘একমত’। আরেক দফা বৈঠকের পরই সবার মতামত নিয়ে বিএনপির নীতি-নির্ধারণী ফোরাম চূড়ান্ত ‘রোডম্যাপ’ জনসম্মুখে প্রকাশ করবে। এরপরই নিরপেক্ষ ও সবার কাছে জাতীয় নির্বাচন আদায়ে ‘কার্যকরী’ আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা। দ্বাদশ সংসদ জাতীয় নির্বাচনের জন্য কর্মপরিকল্পনাও ঠিক করেছে দলটি। তবে এবার বর্জনের মতো ভুল পথে হাঁটবেন না। প্রয়োজন নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। বৃহত্তর আন্দোলনের খাতিরে জাতীয় ঐক্য গড়ার সর্বোচ্চ ছাড় দিতেও রাজি বিএনপি। তবে নির্বাচনে জোট হবে কিনা তা এখনই বলা যাবে না।
বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি অংশ হিসেবে তৃণমূলে ব্যস্ত সময় পার করছে নেতাকর্মীরা। নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মাঠে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে আবারো আন্দোলন গড়ে তোলাই দলের লক্ষ্য। এ ছাড়া ২০২৩ সালের নির্বাচন নিরপেক্ষ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনও আদায় করার চেষ্টা হবে। তাই কূটনৈতিক তদবিরের ওপর বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন দায়িত্বশীলরা।
তারা মনে করেন, রাজনীতির মারপ্যাঁচে মামলা ও গ্রেফতারে নাজেহাল দলের নেতাকর্মীরা। দলীয়প্রধান খালেদা জিয়া এখন অসুস্থ। আর রাজনীতিতে ফিরবেন বলেও মনে হচ্ছে না। দলের দ্বিতীয় নেতাও নেই দেশে। তাদের অনুপস্থিতিতে বর্তমান সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোই দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া বর্তমান নেতৃত্বের কারণে হতাশ ও নিষ্ক্রিয় অনেকেই। আগে যখন বেগম জিয়া নেতৃত্বে ছিলেন তখন তার সঙ্গে নেতা ছিলেন আবদুস সালাম তালুকদার, কে এম ওবায়দুর রহমান, মাজেদুল হক, মতিন চৌধুরী, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, তরিকুল ইসলাম, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমান ও মওদুদ আহমদ। রাজনীতিতে প্রত্যেকেই পোড় খাওয়া যোগ্য ও অভিজ্ঞ নেতা ছিলেন। এখন বেগম জিয়ার আশপাশে যারা আছেন তাদের একটি অংশ বয়সের কারণে তাদের সামর্থ্য সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আরেকটি নেতৃত্ব ওই মানের অভিজ্ঞতা নেই। ওই জায়গায় কিছুটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। তবে দলের তরুণ নেতারা এখন বিএনপির আশা-ভরসা। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রবল সম্ভবনাময়। তারই ভবিষ্যতে দলের কাণ্ডারি।
আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি আগের চেয়ে সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধ। নেতাকর্মীরা জ্বলেপুড়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকারের পতনের জন্য প্রয়োজনে আরো রক্ত দিব। তারপরও এ সরকারকে যেতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান ঘোর দুর্দিনে জনগণকে সংগঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী দুঃশাসনের ছোবলে চারদিকে মহা-আশঙ্কা পরিব্যাপ্ত। আইন, বিচার, প্রশাসনকে সরকার কব্জার মধ্যে নিয়ে জনগণের ওপর স্টিমরোলার চালাচ্ছে। খুন-নির্যাতন, অপহরণ, গুপ্তহত্যা এখন বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ সরকার যেখানে জনগণের প্রতিপক্ষ সেখানে মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা থাকতে পারে না। এই সরকার মরণ খেলায় মেতে উঠেছে। সুতরাং গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এ্বং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে হয়রানির খড়গ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিহিংসার শিকার হয়ে প্রায় ৫ বছর খালেদা জিয়া বন্দি জীবনযাপন করছে। কারণ গণতন্ত্রের প্রতীক এবং জনগণের নাগরিক ও বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে প্রধান কণ্ঠস্বর। দেশের বর্তমান এই ক্রান্তিকালে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিএনপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে দেশবাসীকে বিএনপির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাই।
জানা যায়, ২০১৬ সালের মার্চে দলের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল। গঠনতন্ত্রের তিন বছর পর কাউন্সিল হওয়ার কথা থাকলেও সেই সময় পার হয়ে গেছে। তবে আগামী কাউন্সিল কবে হবে তা জানে না কেউই। এছাড়াও মেয়াদোত্তীর্ণ বেশিরভাগ জেলাই। চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে তরুণদের আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। এছাড়াও সম্প্রতি জামায়াত ইস্যুতেও ২০ দলীয় জোটেও দেখা দিয়েছে ভাঙন। তবে জোটে থাকা বা না থাকা নিয়ে বিএনপি-জামায়াত কোনো দলই আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দেয়নি।
এক দিনের কর্মসূচি: আজ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের কেন্দ্রীয় ও জেলা কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন, শেরেবাংলা নগরে দলের মহাসচিবের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির নেতারা দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। জাতীয় নেতারাসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করবেন। বিকেল ৩টায় নয়াপল্টনে র্যালি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। কাল ২ সেপ্টেম্বর বিএনপির উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে সারাদেশের নেতা, কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ