দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এই সময়ে অনেক ইস্যু পেলেও রাজপথে কার্যত জোরালো আন্দোলন গড়তে ব্যর্থ হয় দলটি। সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই এবার জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে আরো শক্ত অবস্থান গড়তে চায় ঝিমিয়ে পড়া বিএনপি। জনগণের ক্ষোভকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে মাঠ দখলের পরিকল্পনা তাদের। বিশেষ করে রাজধানীর মহাসমাবেশের পর এবার একই ইস্যুতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাঙা করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। তৃণমূল পর্যায়ে আগামী ২২ আগস্ট থেকে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশে ও মানববন্ধনে করবে দলটি। এসব কর্মসূচিতে নিজ নিজ জেলা বা সংসদীয় আসনের বিএনপির নেতাদের থাকার নির্দেশ দিয়েছে হাইকমান্ড। ঢাকায় অবস্থানরত কেন্দ্রীয় নেতাদের একই নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। লক্ষ্য সারাদেশে আন্দোলনে জোয়ার ছড়িয়ে দেয়া। সরকার পতনের ‘একদফা’ দাবিতে রাজপথে দলের কর্মী-সমর্থক বাড়ানোর চেষ্টা। সঙ্গে তৃণমূলের ঘাঁটি আরো মজবুত করা। সরকারবিরোধী বড় মত তৈরি করা। রাজপথে অলআউট নামার আগেই বড় আন্দোলনের ওয়ার্মআপ সেরে ফেলতে চায় দলটি। দলীয় সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকরা বলেন, জ্বালানি তেলের মূলবৃদ্ধি ও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবনে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রতিবাদে শক্তভাবে মাঠে থাকতে চান তারা। এর মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের যুক্ততা বাড়ানোই তাদের লক্ষ্য। রাজধানীসহ সারাদেশে নেতাকর্মীদের চাঙাভাব ধরে রাখতে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের মাঠে রাখা হবে।
দলীয় সূত্রমতে, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে চলতি আগস্ট মাসেই রাজপথে আরেক দফা কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। আগামী ২২ আগস্ট সোমবার থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে দলটি। দেশের সব মহানগর, জেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন করবে। এ লক্ষ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর থেকে সাংগঠনিক জেলা কমিটিগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে। জেলা পর্যায়ে যখন কর্মসূচি পালন করা হবে, তখন সংশ্লিষ্ট জেলার সাবেক সংসদ সদস্য ও অতীতে দলের মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের উপস্থিত থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও নিজ নিজ জেলার কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। জেলা পর্যায়ের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমন্বয় এবং কর্মসূচি কতটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণের জন্য সব বিভাগে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে আলাদা দলও গঠন করা হয়েছে। দফতর থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, আগামী সোমবার প্রতিদিন প্রতিটি জেলা ও মহানগরের কমপক্ষে একটি উপজেলা বা থানায় কর্মসূচি পালিত হবে। উপজেলা, থানা ও পৌরসভার কর্মসূচি ঠিক করবে জেলা কমিটি। ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মসূচি ঠিক করবে উপজেলা, থানা ও পৌর কমিটি। কর্মসূচিতে সহযোগিতা করবে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, সরকারবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। লোডশেডিংসহ গ্যাস সংকটে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। ডিজেল ও সারের দাম বাড়ায় কৃষক দিশেহারা। সাধারণ মানুষের এ ক্ষোভকে কাজে লাগাতে হবে। তৈরি করতে হবে বিএনপির প্রতি তাদের আস্থা। মামলা-ভয় এমনকি মৃত্যু উপেক্ষা করে জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে বিএনপি রাজপথে আছে এমন বিশ্বাস তৈরি করতে হবে। এমনকি ক্ষমতায় গেলে আমরা কী করতে চাই সেই পরিকল্পনাও জাতিকে অবহিত করা হবে। আমরা সেটাও করার পরিকল্পনা নিয়েছি। আশা করি, আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে এক সময় মানুষের আস্থা আসবে এবং তারা রাজপথের আন্দোলনে শরিক হবে। অতীত ইতিহাস বলে— জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামলে সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন। এই মুহূর্তে আমরা সেই কাজটিই করছি। গণদাবির পক্ষে কর্মসূচি নিয়ে কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যন্ত নেতাকর্মীরা ছড়িয়ে পড়ছে।
বিএনপির মিডিয়া সেল সূত্র জানায়, দেশব্যাপী কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের জন্য টিম লিডার হিসেবে ঢাকা বিভাগে দায়িত্বে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, চট্টগ্রামে ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, খুলনায় ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, রাজশাহীতে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, সিলেটে যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বরিশালে যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খান, রংপুরে হারুন অর রশীদ এমপি, ফরিদপুরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান, ময়মনসিংহে যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার, কুমিল্লায় ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু। খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত শামসুজ্জামান দুদু বলেন, কর্মসূচিগুলো যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়, তার জন্য বিভাগীয় টিম করা হয়েছে। মূলত এই কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মীদের অবস্থান সরেজমিনে দেখা, তাদের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকলে তা চিহ্নিত করা এবং বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য কর্মীদের প্রস্তুত করাই হবে আমাদের লক্ষ্য।
জানতে চাইলে বিএনপির বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের লক্ষ্যে বিএনপির আন্দোলন অব্যাহত আছে। জ্বালানি তেল, পরিবহন ভাড়া, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি এবং ভোলায় পুলিশ গুলি করে দলের দুজন নেতা নূরে আলম ও আবদুর রহিম হত্যার প্রতিবাদে আগামী ২২ আগস্ট থেকে উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ে সভা-সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা এই সভা সমাবেশের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে মেসেজ পৌঁছাতে চাই। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। তারেক রহমানসহ দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীর মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। দাবি না মানলে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায়ে এ ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটাতে আন্দোলনের বিকল্প নেই। আমরা সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। সম্প্রতি বিএনপির কর্মসূচিতে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি বলে দেয় আমাদের কতটা প্রস্তুতি রয়েছে। প্রতিটি কর্মসূচিতেই বাড়ছে নেতাকর্মীর উপস্থিতি।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ