আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে এলে বিএনপি নেতাদের সেখানে চা খাওয়াতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই চায়ের আসরে আলাপও হতে পারে। বিএনপির কথা শুনতে চান তিনি। এমনকি আগামী দিনে বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা না দেয়ার প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির আন্দোলনের হুঁশিয়ারির মধ্যেই সরকারপ্রধানের মুখ থেকে এমন বক্তব্য এসেছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানামুখী আলাপ-আলোচনা। অনেকেই বিষয়টিকে ‘আলোচনা বা সংলাপে’ বসার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
বহুদিন পর দেশের রাজনীতিতে আবারো আলোচনায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংলাপ। তবে সংলাপ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সরাসরি নয় বরং ‘নির্দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ঘোষণার শর্তসাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চা খেতে রাজি দলটি। নতুবা অন্য কোনো আলোচনায় যাবে না বিএনপি। ফলে এবার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি ছাড়া আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক টেবিলে আর কোনো চা খাওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চায়ের নিমন্ত্রণের পর দলটি এমন সুরেই কথা বলছে।
দলটি বলছে— অতীতেও বহুবার সংলাপ হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। সংলাপের কোনো প্রতিশ্রুতিই সরকার রাখেনি। সংলাপ শুধুই চা খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। তাই শর্তসাপেক্ষে বিশেষ করে আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘নির্দলীয় সরকার’ বা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ একমাত্র এই ইস্যুতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের বসবে বিএনপি।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে কথা বলতে চায় তখন বিএনপি সেটা দেখবে। তার আগে নয়। আগে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে একমত হতে হবে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে লাভ নেই। আবার কেউ কেউ বলছেন, হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর চায়ের দাওয়াত সন্দেহজনক। এতে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।
গত ১৪ বছরে জনগণের সঙ্গে সরকার বারবার প্রতারণা করেছে। সরকারের এই নরম সুরে গলদ আছে। সংলাপের আমন্ত্রণকে নতুন ষড়যন্ত্রের গন্ধও পাচ্ছেন তারা। এটা মূলত আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়ায় সরকারের একটা ‘টোপ’। রাজপথের কর্মসূচিতে সরকার বাধা দেবে না বললেও বিএনপি নেতাকর্মীরা জড়ো হলেই ফের ধরপাকড় করা হবে বলে শঙ্কা বিএনপি নেতাদের।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে। এই দাবি মানলে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর চা পানের দাওয়াত গ্রহণ করবেন। নতুবা অন্য কোনো আলোচনায় যেতে রাজি না তারা। নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনেও অংশ নেবে না বিএনপি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে চা খেতে অসুবিধা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার কার্যালয়ে এলেই চা খাওয়াবেন। তার আগে ঘোষণা দেন আপনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিচ্ছেন। এসব হালকা কথা বলে কোনো লাভ নেই। একটাই দাবি— পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেই কেবল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার চায়ের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সংলাপে যোগ দেবেন তারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আর কত আলাপ-আলোচনা? সব আলাপ তো শেষ। এখন কার্যকর করার পালা। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই নির্দলীয় সরকারের দাবি করে আসছি। এটি নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি ছাড়া চা খাওয়া যাবে না। এমন সংলাপ তো ২০১৮ সালেও দেখেছি। কী লাভ হয়েছে? সেই আলাপের কথা তো আমরা ভুলে যাইনি। জনগণ দেখেছে গণভবনের সেই আলাপ সরকার কতটুকু রেখেছে।
বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতার ভাষ্য, সরকার এখন নানামুখী চাপে আছে। আন্তর্জাতিক চাপ তো আগে থেকেই আছে। এখন নতুন করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপে পড়েছে। এসব চাপ সামাল দিতে তারা সংলাপের নামে চায়ের দাওয়াত দিচ্ছে। এটাও সরকারের একটা নতুন টোপ। আর বিএনপি যেহেতু রাজপথের আন্দোলনের জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন সরকার চাইছে লোক দেখানো সংলাপ করে থামিয়ে দিতে, যাতে আন্দোলনের আগেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, বিএনপি বর্তমানে শুধু নিজেদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ও ঘর গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। তারপরও বিনা কারণে, বিনা উস্কানিতে গত কয়েকদিনে দলের বেশকিছু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার, আদালতে জামিন নিতে গেলে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। আবার নতুন করে মির্জা ফখরুল রুহুল কবির রিজভীসহ অনেকের নামে মামলা দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা ও পশ্চিমা বিশ্বের এবারের নির্বাচন নিয়ে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। বিপদ আঁচ করতে পেরে সরকার নতুন কৌশলে হাঁটতে চাইছে। তাই বিএনপির ওপর খড়গ-নিপীড়ন চালাতে সরকারের নতুন ইস্যু দরকার। কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামলে হট্টগোল হলেই বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করবে পুলিশ। মামলাও দিবে, গ্রেফতার করবে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আগেও চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। পরে আমাদের নামে ব্যাপকভাবে মামলা দেয়া হয়েছিল। এমনকি যারা হজে ছিলেন, চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তাদের নামেও মামলা দেয়া হয়েছে। এবারের চায়ের দাওয়াতে কী থাকবে? এটা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী চায়ের দাওয়াত কেন দিচ্ছেন? যদি নিরপেক্ষ সরকার দিতে চান। তবে আলোচনা হতে পারে। তবে তারা তো গণতন্ত্রকে জাদুঘরে রেখে দিয়েছেন। সরকার বলে, সংবিধানে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুযোগ নেই। এর দৃষ্টান্ত তো ১৯৯৬ সালে হয়েছিল। গণতন্ত্র আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্য নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না বলেও জানান রিজভী।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ