বিগত ২০০৯ সালের পর অধিকাংশই সাংগঠনিক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও আসেনি সাফল্য। দল পুনর্গঠন ও সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করার কাজে প্রথমে হাত দেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ২০১৬ সালের এপ্রিলে। তখন বেশকিছু জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিলেও বেশিরভাগই ছিল কমিটিবিহীন। এরপর ২০১৯-২০ সালে তৃণমূল পুনর্গঠনে হাত দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেই। তৃণমূলের কমিটি ভেঙে অধিকাংশ জেলার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান; কিন্তু এর মাঝে দুই বছর করোনা ঝড়ে স্থবির ছিল বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম। এরপর সবকিছু স্বাভাবিক হলেও কমিটি আর পূর্ণাঙ্গ হয়নি। বছরের পর বছর ধরে অগোছাল রয়ে গেছে দলটি। কার্যত সাত বছরের বেশি সময় ধরেই পূর্ণাঙ্গ কমিটিজটে বিএনপি। এই মুহূর্তে বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে ২৮টিতে। বাকি ৫৪ জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি দলটি। অর্থাৎ মাত্র ২৩ শতাংশ জেলায় রয়েছে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি। আংশিক বা আহবায়ক কমিটি দিয়ে চলছে বাকি ৬৭ শতাংশ জেলা। এর মধ্যে সবোর্চ্চ পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে রংপুর বিভাগে আর সর্বনিম্ন বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এমতাবস্থায় এ রকম ‘দুর্বল’ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম কতটা সফল হবে তা নিয়েও খোদ বিএনপিতেই আছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। দলের কেন্দ্রীয় ৫০২ সদস্যের ‘ঢাউস’ নির্বাহী কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ তিন বছর ধরে। এছাড়াও বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ নির্বাহী কমিটিতে ৭০টি পদ শূন্য। নানাবিধ কারণে জাতীয় কাউন্সিলও করতে পারছে না দলটি। তবে দলটির নেতাদের বিশ্বাস, আগামী দিনে সরকার পতনের আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকা না থাকার বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পাবে না। পদ-পদবীর ব্যাপারে আগ্রহ থাকলেও বৃহত্তর স্বার্থে নেতাকর্মীরা সবকিছু ভুলে গিয়ে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ পালন করবে।
আর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলে একদিকে যেমন নেতৃত্বশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে বিএনপির গতিশীলতায়ও ভাটা পড়েছে। হতাশা আর মামলায় জর্জরিত হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও।
দলীয় সূত্রমতে, ঢাকা বিভাগে ১১টি, চট্টগ্রামে বিভাগে ১০টি, রাজশাহী বিভাগে ৯টি, খুলনা বিভাগে ১১টি, বরিশাল বিভাগে ৮টি, রংপুর বিভাগে ১০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭টি, ফরিদপুর বিভাগে ৬টি, সিলেট বিভাগে ৫টি, কুমিল্লা বিভাগে ৫টিসহ মোট ৮২টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে বিএনপির। এর মধ্যে সর্বাধিক পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে রংপুর বিভাগে। এ বিভাগে পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটির সংখ্যা ছয়। আর কোনো বিভাগে এর চেয়ে বেশি পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি নেই বিএনপির। রংপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতি মো. তৈমুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আমিন, দিনাজপুর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোফাজ্জল হোসেন দুলাল, সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি, নীলফামারী জেলা বিএনপির সভাপতি মো. আলমগীর সরকার, সাধারণ সম্পাদক মো. জহুরুল আলম, লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু, সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বাবলা, কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি তাসভীরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা, গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সভাপতি ডা. মঈনুল হাসান সাদিক, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন নবী টিটুল। এ বিভাগের বাকি চারটি সাংগঠনিক জেলা- পঞ্চগড়, সৈয়দপুর, রংপুর ও রংপুর মহানগরে রয়েছে বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। নানা কারণে এসব জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারছে না বিএনপি। পূর্ণাঙ্গ কমিটির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম বিভাগ। এখানে ১০টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে কমিটি আছে পাঁচটিতে। চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত নোয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম হায়দার, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল রহমান, কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক শামীম আরা স্বপ্না, খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদ ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক এম এন আবছার, রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দীপন তালুকদার, বান্দরবান জেলা বিএনপির সভাপতি মা ম্যা চিং, সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজা। এ বিভাগের বাকি পাঁচটি সাংগঠনিক জেলা- ফেনী, লক্ষীপুর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, চট্টগ্রাম উত্তর এবং চট্টগ্রাম মহানগরে নেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি। চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে।
পূর্ণাঙ্গ কমিটির দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে খুলনা বিভাগ। চারটিতে আছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। বাকি সাত সাংগঠনিক জেলার নেই কমিটি। এর মধ্যে মেহেরপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণ, সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি মেহেদী আহমেদ রুমী, সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, ঝিনাইদহ জেলা বিএনপর সভাপতি অ্যাডভোকেট এম এ মজিদ, সাধারণ সম্পাদক জাহদুজ্জামান মনা এবং নড়াইল জেলা বিএনপির সভাপতি বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম, সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। আর চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মাগুরা, বাগেরহাট, খুলনা, খুলনা মহানগর এবং সাতক্ষীরায় বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। আহ্বায়ক কমিটিই জেলাগুলোর ভরসা। ঢাকা বিভাগের ১১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে ৩টিতে, নেই ৮টির। এ বিভাগের আওতাধীন মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা, সাধারণ সম্পাদক এস এ জিন্নাহ কবির, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি ডা. দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবু আশফাক, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম, সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর খান সেন্টু। বাকি আটটি সাংগঠনিক জেলা- টাঙ্গাইল, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ), ঢাকা মহানগর (উত্তর), গাজীপুর, গাজীপুর মহানগর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ বিএনপি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। পুণাঙ্গ কমিটি গঠনে পিছিয়ে রাজশাহী বিভাগ। একমাত্র সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে। যার সভাপতি রুমানা মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু। বাকি আট সাংগঠনিক জেলা- বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, রাজশাহী মহানগর, নাটোর, পাবনা এবং জয়পুরহাটে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। দীর্ঘ দিন ধরে এসব জেলা চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে।
পূর্ণাঙ্গ কমিটির দিক থেকে পিছিয়ে থাকা আরেকটি বিভাগ বরিশাল। এ বিভাগে আটটি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে গোলাম নবী আলমগীর এবং হারুন অর রশিদ (ট্রুম্যান) নেতৃত্বাধীন একমাত্র কমিটি আছে ভোলা জেলার। বাকি সাত সাংগঠনিক জেলা- বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল মহানগর, বরিশাল দক্ষিণ, বরিশাল উত্তর, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলার নেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এ জেলাগুলোও চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে।
ময়মনসিংহ বিভাগের সাতটি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে তিনটিতে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এ বিভাগের জামালপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবির তালুকদার শামীম, সাধারণ সম্পাদক ওয়ারেছ আলী মামুন, শেরপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মাহমুদুল হক রুবেল, সাধারণ সম্পাদক মো. হযরত আলী এবং কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরিফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। বাকি চারটি সাংগঠনিক জেলা- ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ উত্তর, ময়মনসিংহ দক্ষিণ এবং নেত্রকোনা বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ