ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিরোধী রাজনীতি!

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নিয়ে মতপার্থক্য * দরকষাকষির জন্যই ‘যুগপৎ আন্দোলনে একমত’ * সমঝোতা হলে ছোট দলগুলোকে ক্ষমতাসীনরা ছাড়বে ১০০ আসন
প্রকাশনার সময়: ১৩ জুন ২০২২, ১৪:০৪

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সরকারকে চাপে রাখাতে এরই মধ্যে আটটি সমমনা দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে দলটি। আন্দোলনের জন্য সবাই একমত। প্রকাশ্যেও বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে দলগুলো।

চলতি মাসে গণফোরাম, বাম দলসহ আরো কয়েকটি দলের সঙ্গেও বৈঠক হবে বিএনপির। নির্বাচনকে সামনে রেখে দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক ঐক্যের আশায় দৃশ্যত বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মতবিনিময় হলেও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন নিয়ে দোলাচলে রয়েছেন বিএনপির নেতারা। পাশাপাশি কোন পথে লক্ষ্য অর্জন হবে- তা নিয়ে সন্দেহ বিরাজ করছে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে। এ ছাড়াও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। বিএনপিসহ বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে এসব তথ্য।

আলাপকালে সরকারবিরোধী একাধিক নেতা বলছেন, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ; নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং সেই কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে বিরোধী দলগুলো ঐকমত্য হয়েছে। তবে ক্ষমতার প্রশ্নে সূক্ষ্মভাবে অমীমাংসিত দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন নেতারা। আর এ দ্বন্দ্বকে ঘিরেই কার্যত সন্দেহ কাজ করছে দলগুলোর নেতাদের মধ্যে।

সূত্র মতে, আগামী সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দাবি আদায়ে সরকারকে চাপে রাখতে গত ২৪ মে থেকে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করে বিএনপি। গতকাল রোববার পর্যন্ত নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সঙ্গে মতবিনিময় করেছে বিএনপি। এসব আলোচনায় সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করার বিষয়ে প্রকাশ্যে বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে দলগুলো। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আলোচনা প্রাথমিক পর্বে রয়েছে। আবারো আলোচনা করে সবার দাবিদাবা এক করে একটি সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে। চলতি মাসেও কয়েকটি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করবে দলটি।

‘সাত দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ’ এর একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে সবাই একমত। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীালীন সরকার নিয়ে চিন্তাভাবনা রয়েছে বিএনপির। তবে সেই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে এ নিয়েও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে সঙ্গে অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর মতপার্থক্য রয়েছে।

তিনি বলেন, বিএনপি মনে করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ হওয়া উচিত ৩ মাস। অন্যরা মনে করে এর বেশি। মেয়াদ বেশি হলে বিএনপির ভয় নতুন রাজনীতির উত্থান। যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকবে, তারা নতুনধারার রাজনীতি সামনে নিয়ে আসবে না- এমন নিশ্চয়তা পাচ্ছে না দলটির নেতারা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়সীমা বেশি হওয়া উচিত কেন এর ব্যাখ্যায় প্রভাবশালী ওই নেতার ভাষ্য, লাখ-লাখ রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ছাড়া কি নতুন নির্বাচন হবে? এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা; গুম-খুনের বিচার করা; বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা, নির্বাচন কমিশন গঠন ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সময় প্রয়োজন।

জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ফরমালি কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ইনফরমালি কথা হচ্ছে। আমরা সবাই বলছি এই সরকারের পদত্যাগের কথা। এরপর কী হবে। কেউ বলছে ইন্টারিন গভর্নমেন্ট, কেউ বলছে কেয়ারটেকার, কেউ বলছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। কেয়ারটেকার মানে কেবল নির্বাচন করবে। নিরপেক্ষ মানে কোনো দলের বিরুদ্ধে কিছু করবে না, সরকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে। তিনি আরো বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বললে কোনোও বিতর্ক নেই। সেই সরকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিবেশ করবে। যতদিন লাগে। তিন মাসে হোক বা তিন বছর এটা মেনে নিতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সন্দেহজনক অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া। তার ভাষ্য, এটা হতে পারে। তবে বিস্তারিত আলোচনা আমি শুনিনি। তবে ইন্টারিন গভর্নমেন্ট নিয়ে আমি কোনও তর্ক-বির্তক যেতে চাই না। এতে আওয়ামী লীগেরই সুবিধা হয়। আমাদের এক দাবি, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ। তারপর দেখা যাবে। এখনই প্রিম্যাচিউর কোনো বিষয়ে আলাপ করতে চাই না।

বিএনপির দায়িত্বশীল দুই নেতা দাবি করেন, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা এবং বিএনপির অন্তর্নিহিত রহস্য ধরে ফেলেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারছে না বিএনপি। এ কারণে তারা একমঞ্চে না উঠে যুগপৎ কর্মসূচির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষত, উভয় পক্ষের সঙ্গে যেন দরকষাকষি করার সুযোগ থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে ছোট দলগুলো আলাদা-আলাদা করে শক্তি প্রদর্শনের পক্ষে।

এ বিষয়ে সাত দলের গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সমঝোতা বা দরকষাকষির কোনও প্রশ্নই নেই। সাত দলের ঐক্যের প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে এই সরকারের পদত্যাগ; অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ের দাবি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই এই দলগুলো এসব দাবিতে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে আসছে। বিএনপিও এই দাবিতে এখন রাজনৈতিক সংলাপের সূচনা করেছে; এটা ইতিবাচক।

জানতে চাইলে সাত দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা কোনো অবস্থাতেই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবো না। এ রকম কোনো চিন্তাভাবনার সুযোগ নাই। তবে এটাও ঠিক, আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই বন্ধু বাড়াতে চাইবে। তারা জানে ১৪ দল দিয়ে হবে না। তারা ইতোমধ্যে নেমে পড়েছে; দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ভবিষ্যতে এটা আরো বাড়বে। বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনে করেন, বিরোধী দলগুলোকে ঠকিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন হবে না। বরং বোঝাপড়া আরও ঘনিষ্ঠ ও স্পষ্ট করে কর্মসূচির দিকে গেলে উদ্দেশ্য সাধন হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল ওই দুই নেতা আরো জানান, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন আয়োজন করতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি শক্তির আগ্রহে আগামী সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার চাপ রয়েছে। সে কারণে পরিস্থিতি যদি অনুকূলে ফেরাতে পারে, সেক্ষেত্রে বিএনপির বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আসন সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে আনতে পারে। সে হিসেবে অন্তত ১০০ আসন ছেড়ে দিতে পারে আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতাসীনদের শুভানুধ্যায়ী কেউ কেউ সহযোগিতার কথা বলছে জানিয়ে গণফোরাম একাংশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, আমরা আসন ভাগাভাগির নির্বাচনে যাবো না। সরকারের পদত্যাগ নিয়ে আমরা অনড়। আমরা এই দাবিতে গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্সের পক্ষে। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই। নিউট্রাল সরকার ছাড়া কোনও নির্বাচনে গণফোরাম যাবে না।

বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, দেশী ও আন্তর্জাতিক শক্তির চাপ তৈরি হলে এবং সব রাজনৈতিক দলকে অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে সক্ষমতা দেখালে নির্বাচনে যেতে পারে বিএনপি। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের অধীনেই নির্বাচনে যাবে বিএনপি। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনো কারণ নাই। যারা আওয়ামী লীগ করে তারাও এটা জানে। সো ফার কেউ আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে, তারা ছাড়া কেউ না।

আসনভিত্তিক সমঝোতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইস্যু তো আসনের না; নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিলে বিএনপি ২০০ আসন দিলেও যাবে না। আমাদের আসন দেবে জনগণ। দেশের মালিক জনগণ, তারা ভোটের মাধ্যমে যাকে নির্বাচন করবে তারা যাবে সংসদে। আসনের খেলা আর চলবে না।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ