সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত। মামলা ও মুক্তির শর্তের বেড়াজালে রাজনীতি বাইরে প্রায় তিন বছর। এরও আগে কারাগারে ছিলেন দুই বছর। সবমিলিয়ে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা বলা চলে শূন্য। দলীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে লন্ডন থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনিও একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। ১৫ বছর ধরে নির্বাসনে থাকা নেতার দেশে ফেরার সম্ভবনাও কম। ঢাকায় দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহাসচিবসহ অন্য নেতারা। তবে বছরের পর বছর ঝিমিয়ে থাকা বিএনপিকে এই নেতৃত্ব টানতে পারছে না বলে দলের ভেতরে-বাইরে রয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চমক হিসেবে নতুন নেতৃত্ব সামনে নিয়ে আসতে চাইছে জিয়া পরিবার। দলের ভাবনা— নির্দলীয় সরকারের দাবি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে জিয়া পরিবার না থাকলে ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার আলোচনায় আসছে জিয়া পরিবারের দুই পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান ও শর্মিলা রহমান সিঁথি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারমানের মেয়ে জাইমা রহমানের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে জোবাইদা ও জাইমার ব্যাপারে আগ্রহী নন শীর্ষ নেতারা। এই বাস্তবতায় সিঁথিকে নিয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনা করছে বিএনপি। দেশে এসে দলের হাল ধরতে পারেন বলেও গুঞ্জন চলছে দলের ভেতরে-বাইরে। তবে এসব আলোচনায় সরাসরি জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কিছু শোনা যায়নি। বিএনপির শীর্ষ নেতারাও স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না বা বলতে পারছেন না। তবে জিয়া পরিবারের ওই তিনজনের কেউ রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
বিএনপির মধ্যম সারির একাধিক নেতা বলেছেন, শর্মিলা রহমান সিঁথি নিজে রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ না দেখালেও সময়ের প্রয়োজনে এবং হাইকমান্ডের নির্দেশে দলের নানা কর্মকাণ্ডে তাকে সম্পৃক্ত হতে দেখা যেতে পারে। সম্প্রতি সিঁথির লন্ডন থেকে দেশে আসা, খালেদা জিয়ার সঙ্গে কয়েকবার কারাগারে সাক্ষাৎ, খালেদা জিয়ার বাসভবন ফিরোজায় বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলোচনাসহ তার নানা কর্মকাণ্ড ওই সম্ভাবনা জোরালো করেছে।
অবশ্য ওই নেতারা এও বলছেন, খালেদা জিয়ার অবর্তমানে তারেক রহমানই দলের পথনির্দেশক। তাকে সহায়তা করার জন্য যে কেউ কাজ করতে পারেন। তিনি পরিবারের সদস্য হলে আরো ভালো।
জানা যায়, দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি চরম দুঃসময় অতিক্রম করছে। সরকারের রোষানলে পড়ে রাজপথে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলছে পারছে না। লক্ষাধিক মামলায় প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মী আসামি। দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত খালেদা জিয়া। জামিনে খালেদা জিয়া জেলের বাইরে থাকলেও নিজের শারীরিক অবস্থা এবং সরকারের দেয়া শর্তের কারণে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারছেন না। বিএনপি চেয়ারপার্সন হলেও দলীয় কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না তিনি। অন্যদিকে, দেশে ফিরলেই সাজার মুখোমুখি হতে হবে বিধায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও দেশে ফেরার সংকেত দিচ্ছেন না। দুই শীর্ষ নেতার এমন অবস্থার কারণেই আলোচনায় আসতে থাকে জোবায়দা ও সিঁথির নাম।
দল ও পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, কয়েক মাস আগেও জোবাইদাকে রাজনীতিতে আনতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সে সময় দেশের রাজনীতি এবং মিডিয়ায় জোরালো আলোচনা ছিল ‘রাজনীতিতে আসছেন জোবাইদা’। তবে ভারপ্রাপ্তের অনাগ্রহের কারণে সে আলোচনা বেশি দূর এগোয়নি। জোবাইদা রহমান রাজনীতিতে না গিয়ে সন্তানদের সময় দিলে পরিবারের জন্য ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি। তার এমন ইচ্ছায় বিষয়টি নিয়ে খালেদা জিয়াও বেশি দূর আগাননি। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প বা সহায়ক হিসেবে অন্য কোনো ব্যক্তির কথা নেতাকর্মীদের মাঝে আলোচনায় আসে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথির নাম আসে আলোচনায়।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সিঁথি দেশে আসার পর ফিরোজায় তার সঙ্গে দেখা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সে সময় তিনি তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কিছু বার্তা পৌঁছে দেন। গত সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে তার প্রভাব ছিল বলে গুঞ্জন রয়েছে।
দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপির একটি অংশ এই মুহূর্তে জিয়া পরিবারের কারো রাজনীতিতে আসাকে মানতে চায় না। তাদের আশঙ্কা— রাজনীতিতে পারিবারিক উত্তরসূরির প্রাধান্য ঘটলে দীর্ঘদিন ধরে যারা রাজনীতি করছেন তারা বঞ্চিত হন। তবে বিষয়টি নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, বিএনপিতে লিডারশিপে কোনো সমস্যা নেই। খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার পর থেকেই দল চালাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। স্থায়ী কমিটির সঙ্গে আলোচনা করেই যে কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। ফলে লিডারশিপে কোনো সমস্যা নেই।
তিনি বলেন, বিএনপিকে দুর্বল করতেই লিডারশিপের প্রশ্ন তোলে সরকার। তবে তারেক রহমানের নেতৃত্বে যে কোনো কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ডিজিটাল যুগে যে কোনো সিদ্ধান্ত পাঁচ মিনিটে দেয়া যায়। এখানে কোনো সমস্যা নেই। তবে সব সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান নেবেন।
জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদুস তালুকদার দুলু নয়া শতাব্দীকে বলেন, খালেদা জিয়া এখনো দলের প্রাণভোমরা। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। তার জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে। খালেদার অনুপস্থিতিতে কর্তৃত্ব দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের। লন্ডন থেকে দলকে কন্ট্রোল করছেন তিনি। বিএনপির কমিটি, কর্মসূচি বা যে কোনো সিদ্ধান্ত সবার সঙ্গে আলোচনা করে নিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যদি চান, তারা যদি আসেন, তাতে অখুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং সবাই খুশি হব। বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাগত জানাবে। তারা যদি রাজনীতিতে আসেন তাহলে বিএনপির জন্য ভালো হবে এবং রাজনীতিতেও সুবাতাস বইবে। এতে দলের নেতাকর্মীরা নতুনভাবে উদ্দীপ্ত হবেন।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও জিয়া পরিবারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, এই মুহূর্তে এ ধরনের কোনো আলোচনা শুনিনি। ডা. জোবাইদা রহমানের যে পারিবারিক ঐতিহ্য, তাতে তিনি যদি রাজনীতিতে আসেন বাংলাদেশের মানুষ সেটা খুবই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে। সরকার তার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে বানোয়াট, ভিত্তিহীন মামলা দিয়েছে। ভবিষ্যতে তিনি রাজনীতি করতে পারেন এই ভয়ে ভীত হয়ে সরকার এটা করেছে।
একই বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ভবিষ্যতে কী হবে না হবে— জাইমা রহমান-সিঁথি রাজনীতিতে আসবে কিনা সেটা এখন বলতে পারছি না। তবে জিয়া পরিবার থেকে যারাই রাজনীতি আসবে তারা নিশ্চয়ই যোগ্যতা নিয়ে আসবে। তাদের সেই যোগ্যতা আছে। কারণ, তাদের শরীরে জিয়া পরিবারের রক্ত। জিয়া পরিবারের উত্তরসূরি।
পারিবারিক সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর শর্মিলা রহমান সিঁথি তার দুই সন্তানকে নিয়ে মালয়েশিয়া থেকে লন্ডনে চলে যান। এখন তারা লন্ডনেই বাস করছেন। শর্মিলার জন্ম মাগুরায় মামাবাড়িতে। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান না হলেও বৈবাহিক সূত্রে চলে এসেছেন রাজনীতির আলোচনায়।
নয়া শতাব্দী/এমআরএইচ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ