দীর্ঘ ১৫ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দলটি। প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর মাথায় ঝুলছে লক্ষাধিক মামলা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অবস্থান পাঁচ হাজার মাইল দূরে লন্ডনে। আর সাজা মাথায় নিয়ে গুলশানে ফিরোজায় রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এমতাবস্থায় ২০২৩ সালে হবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে দলের প্রধান দুই নেতার অংশগ্রহণ ও নিরপেক্ষ হওয়া নিয়েও ঘোর সংশয়ে রয়েছে বিএনপি। রাজনৈতিক সমঝোতার পথও অনেকটাই ক্ষীণ। তাই নির্বাচন সামনে রেখে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ও আন্দোলনমুখী করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
আওয়ামী লীগ সরকার পতন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখার বিষয়ে অনড় রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ধারাবাহিকতায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলা সফরে গিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো দ্রুততার সঙ্গে শেষ করারও তাগিদ দিয়েছেন তিনি। দলীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন দলের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা না রাখলেও বড় ছেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছ থেকে নিয়মিত দলের খবর নেন, পরামর্শ দেন। তারা বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী হবেন খালেদা জিয়া।
দলটির কারো কারো মত, খালেদা জিয়া এই মুহূর্তে দলের অভিভাবক হিসেবে দলকে শাসন করতে পারতেন এবং দেশের মানুষের সামনে সুস্থ রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হতে পারতেন। ঠিক যেমন ১৯৮১ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর ভূমিকা নিয়েছিলেন বেগম জিয়া। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এবারো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সরকার হটানোর আন্দোলনে খালেদা জিয়া ভূমিকা রাখবেন বলেও দলটির নেতাকর্মীদের বিশ্বাস। তার উপস্থিতিই সব হিসাব পাল্টে দিতে পারে। সরকারের ওপর চাপ তৈরি বা পতন হলে আগামী নির্বাচনেও বিএনপি চেয়ারপারসন অংশ নিতে পারবেন বলেও তাদের বিশ্বাস।বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, বিএনপি জিয়াউর রহমানের মতো সামরিক ব্যক্তির হাতে গড়া হলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে পূর্ণতা পেয়েছে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজপথে থেকে। সরাসরি গৃহবধূ থেকে রাজনীতে আসেন ১৯৮২ সালে। রাজপথে টানা আট বছরের আন্দোলনের পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এতে করে বিএনপির ভিত জনগণের মধ্যে পোক্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে খালেদা জিয়াই প্রধানমন্ত্রী হবেন। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষ পরিষ্কার জানে যে, বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় আসবে। আসলে আমাদের তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আছেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে আমরা কোনো নির্বাচনে যাব না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও যাবে না। এটা পরিষ্কার। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, ফয়সালা হবে রাজপথে। আওয়ামী লীগ সরকারকে হটিয়ে সংসদ ভাঙতে বাধ্য করে তারপরে নির্দলীয় ূ সরকার প্রতিষ্ঠা করে এদেশে একটি সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করব।
একাধিক সূত্রের দাবি— সম্প্রতি খালেদা জিয়া একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়েছেন। ওই নেতা তার স্ত্রীসহ বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে কোনো পক্ষই বিষয়টি স্বীকার করেনি। ধারণা করা হচ্ছে— ওই নেতার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ চিন্তা সম্পর্কে স্পষ্ট হতেই ওই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। পরে অবশ্য ওই নেতাকে বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজা পাওয়া সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী শর্তসাপেক্ষে পঞ্চম দফায় সরকারের নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত এখন। আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি কারাগারের বাইরে থাকবেন। বর্তমানে গুলশানের বাসা ফিরোজায় একান্ত জীবনযাপন করছেন। নানা রোগ-শোকে আক্রান্ত ৭৭ বছর বয়সি বিএনপি চেয়ারপারসন বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। দৈনিক পত্রিকা পড়েন নিয়মিত। পরিবার ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের বাইরে তেমন একটা দেখা সাক্ষাৎ দেন না তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া একজন ইউনিক চরিত্র, যিনি গৃহবধূ হয়েও রাস্তায় থেকে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলন করে নির্বাচন করেছেন। প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। জীবনে যতগুলো আসন থেকে নির্বাচন করেছেন, সবগুলোতে জিতেছেন। এটা রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।
তিনি বলেন, এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, তিনি যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে তার যে আপসহীনতা সব মিলিয়ে তিনি আজকের এই বেগম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আর দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। অতীতে আন্দোলন করে দেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এবারো রাজপথ আন্দোলনে তা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
জানা যায়, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে কয়েকবার আটক করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন। এবারো আন্দোলন হলে ফের কারাগারে যাওয়ার ভয় নেই খালেদা জিয়ার। ওয়ান ইলেভেন ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ব্যাপক ভরাডুবি হয়। এরপর থেকে দলটি রাজনৈতিকভাবে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় তার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারেননি।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ