ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
অপহরণ ও হত্যা মামলার আসামি সদস্য সচিব

তৃণমূলে সমালোচনার ঝড়

চট্টগ্রাম বিএনপি
প্রকাশনার সময়: ১৮ মে ২০২২, ১০:২৩

২০০৩ সালের ১৩ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট থেকে অপহরণ হন বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন আহম্মদ। দুই বছর পর ২০০৫ সালে ২৪ আগস্ট তার কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছিল ফটিকছড়ির দইজ্জ্যাখালি পাহাড় থেকে। ওই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত জামাল অপহরণ ও হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। আর তাকেই সদস্য সচিব করা হয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার। গত শনিবার কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপি। অথচ এক মাস আগে নিজ দলের নেতা হত্যা মামলা, চেক প্রতারণা মামলাসহ একাধিক অভিযোগ তুলে হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে লিখিত আকারে জমা দেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির আট সদস্য। তারপরও নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে বিতর্কিত হেলালের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে বিএনপির অনেক নেতাই। তাকে পদ রাখাতে কমিটি প্রকাশ করা হয় তিন সপ্তাহ দেরিতে।

বিএনপি নেতার হত্যা মামলার আসামির সঙ্গে একই কমিটিতে নাম থাকায় ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই উত্তাল চট্টগ্রাম বিএনপির রাজনীতি। তৃণমূলে বইছে সমালোচনার ঝড়। নেতাদের দাবি, হেলাল উদ্দিন অতীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার পদ বাতিলের দাবিও জানিয়েছেন তারা।

হেলাল উদ্দিনকে সদস্য সচিব করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জামাল উদ্দিনের ছেলে চৌধুরী ফরমান রেজা লিটন বলেন, অপহরণের পর আমার বাবার কঙ্কাল ছাড়া কিছুই পাইনি। সিঙ্গাপুরে ডিএনএ পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যায় কঙ্কালটি আমার বাবার। মামলায় গ্রেফতারকৃত তিন আসামির ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তির পর হেলাল উদ্দিনসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এখন আমার বাবার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কেউ বিএনপির নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন, এটা আমাদের জন্য অপমানজনক ও কষ্টকর।

তিনি বলেন, আমার বাবা আমৃত্যু বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমি ও আমার পরিবার দেড় যুগ ধরে ন্যায়বিচারের জন্য আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমাদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম আছে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে লিখিত অভিযোগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা। এ ছাড়াও অভিযোগ তদন্তে স্থায়ী কমিটি রয়েছে। তবে বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বিএনপি। বিতর্কিত কেউ দলে পদায়ন হোক— এটা বিএনপি চায় না।’

জানা যায়, গত শনিবার মোশারফ হোসেন চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও লায়ন হেলাল উদ্দিনকে সদস্য সচিব করে ৬১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে দক্ষিণ জেলা বিএনপি। অথচ প্রায় এক মাস আগে ১৭ এপ্রিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বরাবর দেয়া এক চিঠিতে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আট সদস্য অভিযোগ করেন, মো. হেলাল বিএনপি নেতা জামালউদ্দিন হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। এই মামলায় তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি চেক প্রতারণা মামলায় এক বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। একই মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামি রফিক উদ্দিন আনোয়ারার চরলক্ষা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। এরপরও কমিটিতে তাকে রাখা নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করা নতুন কমিটিতে আহ্বায়ক পদ পাওয়া মোশারফ হোসাইনসহ সাতজনকে যুগ্ম-আহবায়ক করা হয়েছে।

এদিকে, কেন্দ্রে জমা দেয়া লিখিত অভিযোগের তোয়াক্কা না করে তড়িঘড়ি করে কমিটি প্রকাশ করেছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান ও সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ। যদিও দুজন কমিটি অনুমোদন দিয়ে স্বাক্ষর করেছেন ২০ এপ্রিল, আর প্রকাশ হয় ১৫ মে। কমিটি অনুমোদনের তিন সপ্তাহের বেশি সময় পার করে সেটি প্রকাশ করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। অনুমোদনের দিনই কেন কমিটি প্রকাশ করা হলো না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগ তৃণমূল নেতাকর্মীদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ জেলা বিএনপির শীর্ষ এক নেতা বলেন, সবাই একাট্টা হয়ে অভিযোগ দিয়েছেন হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে। অভিযোগগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং এর সত্যতা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। এ কারণে পেছনের তারিখ দিয়ে স্বাক্ষর করা হয়েছে উপজেলার নতুন আহ্বায়ক কমিটি। ত

বে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় বিএনপি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, লিখিত অভিযোগের কপি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে ইমেইলে দেয়া হয়েছে। দলের মহাসচিবকে হাতে হাতে অভিযোগের অনুলিপি দেয়া হয়েছিল। অনুলিপি দেয়া হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকেও। ফলে অভিযোগ তদন্ত করার বিষয়ে লন্ডন থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগেই সাংগঠনিক টিমকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখার কৌশল এটি। তবে চিঠির বিষয়ে জানতে স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

চিঠিতে আনোয়ারা উপজেলা থেকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে স্থান পাওয়া নয়জনের মধ্য আটজনের স্বাক্ষর রয়েছে। চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, জামাল উদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলায় মো. হেলালের প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি এ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া আসামি শহিদ চেয়ারম্যান, কালা মাহবুব, সোবহান ড্রাইভার আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন। মো. হেলাল এর আগে আনোয়ারার কোনো ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা বিএনপির পদ-পদবিতে না থাকলেও তাকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়। এমন বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলের নেতৃত্বে আনা নিয়ে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। হেলাল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

নেতারা আরো অভিযোগ করেন, হেলালের বিরুদ্ধে চেক প্রতারণার মামলা রয়েছে। দলের বিভিন্ন নেতা ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধার করা টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগে অনেক মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সুত্রমতে, বিএনপি চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকও এমন বিতর্কিত ব্যক্তিকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিবের মতো পদে বসিয়ে সমালোচিত হতে নারাজ ছিলেন। তবে আগামী সংসদ নির্বাচনে হেলালকে আনোয়ারা আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী করার চিন্তা করেই ঝুঁকি নিয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা। গেল সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে বিএনপির সাবেক এমপি সরওয়ার জামাল নিজাম নির্বাচনে অংশ নিলেও বর্তমানে তিনি আনোয়ারার রাজনীতিতে অনেকটাই নীরব। বিকল্প প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া মোস্তাফিজুর রহমানকে ২নং যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে কমিটিতে।

জানতে চাইলে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মোশারফ হোসেন চৌধুরী বলেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত হেলাল মুলত আওয়ামী লীগের সংগঠক হিসেবেই আনোয়ারায় পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে দলের একটি সিন্ডিকেটের হাত ধরে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেছে। হঠাৎ করেই তাকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তিনি বলেন, দলের একজন নেতার হত্যার সঙ্গে জড়িত এমন বিতর্কিত ব্যক্তিকে হাইকমান্ডের ইশারার অজুহাতে উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব করা হলো। নতুন আহ্বায়ক কমিটির প্রায় সব নেতা এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলাম।

লিখিত অভিযোগ দেয়া দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মেজবাহ চৌধুরী (জাহেদ) বলেন, ‘হেলালের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও তাকে দলে রাখায় আমরা হতাশ।

দক্ষিণ জেলা বিএনপির আট সদস্যের দেয়া লিখিত অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ বলেন, অভিযোগ যে কেউ করতেই পারেন। আমরা তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব। হেলালের বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলার বিষয়েও লোকমুখে শুনেছি। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।

এ বিষয়ে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম নয়া শতাব্দীকে বলেন, হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে। বিতর্কিতদের কাউকে নেতৃত্বে না আনার বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, নিজ দলের নেতা হত্যার সঙ্গে আমার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। চেক প্রতারণার মামলাটি আমার একটি কোম্পানি অজান্তে করেছে। সেটির সঙ্গেও আমার সম্পর্ক নেই।

জানা যায়, চাঞ্চল্যকর জামাল উদ্দিন অপহরণ ও হত্যার পর ২০০৩ সালে ২২ জুলাই বিএনপির সাবেক সাংসদ সরওয়ার জামাল নিজামের ছোট ভাই মারুফ নিজামসহ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন তার ছেলে চৌধুরী ফরমান রেজা লিটন। এখন পর্যন্ত ৩৮ দফায় তারিখ ধার্য করা হলেও সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি। মামলার ১৬ বছর পার হলেও মূল আসামিদের বাদ দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি, জালাল উদ্দীনের পরিবারের নারাজি দাখিল, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ, সাক্ষ্যগ্রহণে ধার্য করা দিন পরিবর্তনের জটে চট্টগ্রামের শিল্পপতি ও বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড মামলার নিষ্পত্তি হয়নি এখনো।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ