আবারো আলোচনায় বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। সম্প্রতি তার সুস্থতার খবরে দলের ভেতর শুরু হয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ। দলে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গত ১১ এপ্রিল সৌদি আরবের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ্কে নিজের রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে রওশনকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে নির্বাচনি হিসাব-নিকাশ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি মাসেই থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরবেন বিরোধীদলীয় নেতা। আর অংশ নেবেন সংসদের বাজেট অধিবেশনে। একই সঙ্গে দেশে ফিরে নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও গোলাম মসীহ্কে মহাসচিব হিসেবেও ঘোষণা করতে পারেন। এসবের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে গুলশান-২-এ একটি পার্টি অফিস ভাড়া নেয়া হচ্ছে। একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিরোধীদলীয় নেতার সহকারী একান্ত সচিব মো. মামুন হাসান নয়া শতাব্দীকে জানান, কয়েকদিন আগে ম্যাডাম ফোন দিয়েছিলেন এবং দলের সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। সে সময় তিনি দেশে ফিরে আসছেন বলে জানান। তবে কবে ফিরেছেন- দিণক্ষণ চূড়ান্ত করে জানাননি। তার নির্দেশেই গত ১১ এপ্রিল গোলাম মসীহ্কে রাজনৈতিক সচিব হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি ম্যাডামের অনেক বিশ্বস্ত। এর আগে ২০১৪ সালেও তিনি ম্যাডামের রাজনৈতিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে নতুন দল গঠনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মামুন হাসান। জানা গেছে, চলতি বছরের ১১ এপ্রিল বিরোধীদলীয় নেতার সহকারী একান্ত সচিব মো. মামুন হাসান একটি চিঠি ইস্যু করেন। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ্কে তার রাজনৈতিক সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এর আগে তিনি ২০১৪ সালে একই পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও বিধায়ক মরহুম আব্দুল আওয়ালের তৃতীয় পুত্র। গোলাম মসীহ্ ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ব্রিটিশ পেট্রেলিয়াম, টোটাল গ্যাস, এশিয়া স্যাটেলাইট, হংকং টেলিকম, জেনারেল অ্যাটকিসসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করেন। তিনি ২০১৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিকবিষয়ক প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। এরপর ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সৌদি আরবের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ওআইসির স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ধরনের চিঠি ইস্যুর পর তোলপাড় শুরু হয় জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরে।
জানতে চাইলে রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ম্যাডাম রওশন এরশাদ এখন অনেকটাই সুস্থ। দেশে কবে নাগাদ ফিরবেন তা এখন বলা যাচ্ছে না। তার সুস্থতার জন্য প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করছেন দলের নেতাকর্মীরা। ম্যাডাম দেশে ফিরলে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা আরো চাঙা হবে। রাজনীতির পরিস্থিতিও কিছুটা আলাদা হবে। পাল্টে যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আলাদা হচ্ছে কথাটি ঠিক নয়। আলাদা অফিস নেয়া হচ্ছে— এটাও ঠিক নয়। ম্যাডাম তো দেশের বাইরে। তাই এর বাইরে আমি আর কিছুই জানি না। তবে আগামী নির্বাচনে দেখা যাবে লাঙ্গল প্রতীক কে পাচ্ছে।
জানা গেছে, আগামী নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর কদর। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির কদর এখন সরকার ও প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এদিক থেকে সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে রওশন এরশাদ সব সময় এগিয়ে রয়েছেন। এছাড়া লাঙ্গল প্রতীকও রওশনের নামে নিবন্ধিত। এ কারণে তার সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকেও যোগাযোগ করা হয়েছে। রওশন চাইলে সরকার সহযোগিতা করবে বলেও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এমন নিশ্চয়তার পর নড়েচড়ে বসেছেন রওশনপন্থিরা। তারা রওশনকে সামনে রেখে নতুন জাতীয় পার্টি গঠন করতে চান। সেখানে মহাসচিব হিসেবে গোলাম মসীহ্কে দেখা যাবে বলে জানা গেছে।
জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরে বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। যেহেতু সরকারের আশীর্বাদ রয়েছে রওশনের দিকে এ কারণে জিএম কাদেরের পাশে থাকা নেতারাও রওশনপন্থিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। তারাও চাচ্ছেন রওশনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টি আবারো নির্বাচনে আসুক। এতে সরকারের কাছ থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে বলে এসব নেতাকর্মীর ধারণা। বিশেষ করে গোলাম মসীহ’র বাবা আব্দুল আওয়াল ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বিধায়ক। এ কারণে তিনি সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত।
এর আগেও ২০১৪ গোলাম মসীহ্ বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়ও সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ ধরে রাখেন গোলাম মসীহ্। এ কারণে বিরোধীদলীয় নেতার বিশেষ সুপারিশে গোলাম মসীহ্কে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত করা হয়। তবে এবার গোলাম মসীহ্কে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখতে চায় একটি পক্ষ। এ কারণে রওশনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির মহাসচিব হিসেবে তাকেই বেছে নেয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, গত বছরের নভেম্বরের দিকে অসুস্থ হয়ে থাইল্যান্ডে যান বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে তিনি এখন সুস্থ। পায়ের কিছু সমস্যার জন্য তাকে ১০টা থেরাপি দেয়াও এখন শেষ পর্যায়ে। থেরাপি দেয়া শেষ হওয়ার পরপরই তিনি চলতি মাসের শেষের দিকে দেশে ফিরবেন। এইচ এম এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশা এরশাদ বসবাস করার কারণে দেশে ফেরার পর তিনি বিরোধীদলীয় নেতার সরকারি বাসভবনে উঠবেন। এজন্য তার বাসভবন সংস্কারের কাজ শুরু করা হয়েছে। আনা হয়েছে ইট-বালুও। বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবন বসবাস ও ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সর্বসাধারণের জন্য গুলশান-২ নম্বর এলাকার একটি রাজনৈতিক অফিস নেয়া হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতেও একটি ভবন ভাড়া নেয়া হয়েছিল। কিন্তু পার্টি অফিস হওয়ার কারণে পরে তা বাতিল করেন ভবন মালিকপক্ষ। এদিকে, দেশে ফেরার দিন বিমানবন্দরে বড় ধরনের শোডাউনের চিন্তা করছেন রওশনপন্থিরা। ওইদিন সেখানে জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠদেরও দেখা যেতে পারে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সার্বিক বিষয় নজরদারি করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তারাও সরকারকে সার্বক্ষণিক আপডেট জানাচ্ছে।
সূত্রমতে, রওশন এরশাদ সুস্থ হওয়ার খবরে দলের হেলিওয়েট নেতারা তার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের এক প্রভাবশালী নেতা ও এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অন্যতম। পাশাপাশি জিএম কাদের পাশে থেকেও অনেকে রওশনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। নিজের অবস্থান ঠিক করার পর রওশন এরশাদ প্রেসিডেন্ট পার্কের বিষয়ে চিন্তা করবেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, জাতীয় পার্টির নির্বাচনি প্রতীক লাঙ্গল রওশনের নামে। তাই অন্যরা যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে রওশনের নেতৃত্বে একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন জাপা নামে আত্মপ্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত লাঙ্গল প্রতীক থাকবে রওশন এরশাদের। ফলে জাপার প্রায় সব সংসদ সদস্য রওশন এরশাদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে একজোট হচ্ছেন। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন জাপার নেতারা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, জাতীয় পার্টি নামে মাঠে এখন সক্রিয় আছে পাঁচটি দল। এর মধ্যে চারটির নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন আছে। এমন অবস্থার মধ্যেই দলটিতে আবারো ভাঙনের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখন এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের, স্ত্রী রওশন এরশাদ ও বিদিশা এরশাদের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব চলছে। জাপায় এখন রওশন, বিদিশা ও কাদেরের নেতৃত্বে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত। এই তিন নেতার প্রত্যেকেই দলে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বলয় তৈরি হয়েছে। তাদের লক্ষ্য সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার আসন।
জানা যায়, ১৯৮৬ সালের পহেলা জানুয়ারি ‘সরকারি রাজনৈতিক দল’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে জাতীয় পার্টির। প্রথম দফায় জাতীয় পার্টি ভাঙনের কবলে পড়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে। দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে জাতীয় পার্টি (জেপি) গঠন করেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। দলটির নিবন্ধিত প্রতীক বাইসাইকেল। বর্তমানে তিনি সাংসদ হিসেবে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। দ্বিতীয় দফায় ভাঙনের শিকার হয় নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে। তখন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) গঠন করে। দলটির নিবন্ধিত প্রতীক গরুর গাড়ি। এখন বিজেপির প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। এই অংশটির ভেতরও আরেকটি ভাঙন আছে। মন্ত্রিত্ব নিয়ে ঝামেলার একপর্যায়ে এম এ মতিন আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। দলটির কাঁঠাল প্রতীকে তাসমিনা মতিনের নামে নিবন্ধন আছে।
সর্বশেষ প্রয়াত কাজী জাফর আহমদের হাত ধরে ভাঙনের শিকার হয়েছে। এ সময় জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) একাংশ গঠন করেন। তিনি এরশাদের জীবদ্দশায় জাতীয় পার্টি তিন দফায় ভেঙেছে। তার মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় আবারো ভাঙনের মুখে পড়ল দলটি। তিনটি দলই লাঙল প্রতীক ব্যবহার করছে। তবে এরশাদের নেতৃত্বাধীন এই অংশটি মূল জাতীয় পার্টি হিসেবে পরিচিত। নির্বাচন কমিশনে এ দলটি নিবন্ধিত লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ