করোনার প্রভাব কাটিয়ে দুই বছর পর মাঠে ফিরেছে রাজনীতি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের হুঙ্কার দিচ্ছে বিএনপি। এ জন্য ডান-বামসহ ছোট ছোট দল নিয়ে বড় ধরনের মোর্চা করার চেষ্টা করছে। যদিও দীর্ঘদিন থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি ও তার মিত্ররা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে সফল না হওয়ায় বিএনপির আন্দোলনের হাঁকডাক কোনোভাবেই পাত্তা না দিয়ে স্বস্তির ঢেঁকুরই তুলছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বিবেচনায় রেখে আগামী নির্বাচনে জোট গঠনের বিষয়ে জাতীয় পার্টি (জাপা)। নিবন্ধন না থাকলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে বলে জানা যায়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর বাকি থাকলেও এখন থেকেই তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে চাচ্ছেন রাজনৈনিতক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা। আগামী ডিসেম্বরের সম্মেলন ঘিরে দলে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আর ঝিমিয়ে পড়া কর্মীদের চাঙা করতে এবারের ঈদে এলাকায় ছুটে গেছেন বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। জাকাত বা বিভিন্ন দান বা অনুদানের নামে সহযোগিতা নিয়ে কর্মীদের পাশে এবার দাঁড়িয়েছেন। অনেকে এলাকায় যেতে না পারলেও নিজ নির্বাচনি এলাকায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন ঈদ উপহার। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন ও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও হয়েছেন এলাকামুখী। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কুশল ও শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন তারা। ঈদ উপহার বিতরণের পাশাপাশি ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়ে গণসংযোগ করেছেন, চা-চক্রসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে সাধ্যমতো সহায়তা করছেন।
ঈদপরবর্তী সময়ে বিএনপি আন্দোলনে নামবে এমন প্রশ্নে— আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘এ বছর না ওই বছর, আন্দোলন হবে কোন বছর। বিএনপি ১৩ বছরে ২৬ বার আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। বিএনপি আন্দোলনের কথা বললে মানুষ হাসে, মানুষ বলে ১৩ বছরে আন্দোলন করতে পারল না, কোন বছর পারবে।’ তবে আশঙ্কা প্রকাশ করে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেন, যে কোনো সময় রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে পারে। তবে বিরোধী দল যতই আন্দোলনের ডাক দিক তারা অতীতের মতোই সফল হবে না।
তিনি বলেন, আবার রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হবে বলে মনে হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তপ্তের কথা যেটা বলেছি, তারা (বিএনপি নেতারা) আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন। তারা ধর্মঘট করবেন, বাংলাদেশকে অচল করে দেবেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন দেশে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে দেশে কোনো হরতাল নেই, ধর্মঘট নেই, রাজনৈতিক অঙ্গন ওইভাবে উত্তপ্তও হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলেছে।
ঈদের পর বিএনপি অন্যান্য দলকে নিয়ে আন্দোলনে নামবে— এমন এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, তাদের আন্দোলন আসলে কোন ঈদের পরে? আমরা গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঈদের পরে, রোজার পরে, বার্ষিক পরীক্ষার পরে, শীতের পরে, বর্ষার পরে তাদের আন্দোলন হবে এ রকম শুনে আসছি। কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন দেখছি না। তাই কোন ঈদের পরে সেটি একটু খোলসা করলে ভালো হয়।’ তিনি বলেন, বিএনপির রাজনীতিটা গতানুগতিক বক্তব্যের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের রাজনীতি তিনটি বিষয়ের মধ্যে আবর্তিত— খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য, তারেক জিয়ার শাস্তি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিরোধী দল হিসেবে যে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার কথা, বিএনপি সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং হচ্ছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ক্ষমতার মোহে এরা দেশকে গণতন্ত্রশূন্য করে নিজেদের বিবেকবর্জিত ও মনুষ্যত্বহীন করে তুলেছে। গণতন্ত্রের মূলোৎপাটন করে সরকারের ভয়াবহ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে নির্মমভাবে স্তব্ধ করে যাচ্ছে শুধু ক্ষমতার বেপরোয়া যথেচ্ছাচার টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু জনগণ এখন আওয়ামী সরকারের ভয়াবহ দুঃশাসন প্রতিরোধে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
নিবন্ধনহীন জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে আছে কি নেই এমন প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলছেন, নিজেদের করণীয় জামায়াত নিজেই ঠিক করবে। এর আগেও জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলন করেছে। জামায়াতের সঙ্গে আমাদের আদর্শিক কোনো মিল নেই। এখন যেহেতু তাদের নিবন্ধন নেই সেহেতু তাদের করণীয় তাদেরই ঠিক করতে হবে। সরকারবিরোধী ঐক্যের মেরুকরণের লক্ষ্যে নানান তৎপরতা চলছে বলেও জানান বিএনপি মহাসচিব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, জামায়াতকে জোটে না রাখার ব্যাপারে অধিকাংশ নেতাই একমত। কিন্তু জামায়াতকে বিভিন্ন কৌশলে আওয়ামী লীগ কাছে টেনে নেবে, আগের মতোই সে বিষয়টি নিয়েও তাদের ভাবতে হচ্ছে। মোট কথা— জামায়াতকে নিয়ে ‘নেতিবাচক’ কোনো কথা বলতে চান না তারা। এসব হিসাব-নিকাশ কষে জামায়াতকে বাইরে রেখে নতুন জোট গঠন করতে চায় বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, বিএনপির চলমান আন্দোলন ক্ষমতার জন্য নয়, এটি দেশ মুক্তির আন্দোলন। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। তার গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার আন্দোলন। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আরো বলেন, আন্দোলন কোনো দিনক্ষণ ঠিক করে আসে না। বর্তমানে দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাড়ছে সেটাই চূড়ান্ত আন্দোলনের লক্ষণ।
জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, নির্বাচনকালে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বিবেচনায় রেখে আগামী নির্বাচনে জোট গঠনের বিষয়ে জাতীয় পার্টি সিদ্ধান্ত নেবে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনি এলাকায় কাজ করছেন। আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় পার্টি। তবে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি— এককভাবে আন্দোলন করার সক্ষমতা হারিয়েছে বিএনপি। তাই এখন অন্যদের দলে টানার চেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এ দেশের কোনো প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেবে না। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিএনপি নির্বাচন দাবি করলেও নির্বাচনের মাঠ থেকে শেষ পর্যন্ত সরে যায় কিনা তা নিয়ে বরং দেশের মানুষ শঙ্কায় আছে। কারণ বিএনপি নির্বাচন ও জনগণকে ভয় পায়, তাই তারা গণরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়।
বিএনপির কয়েক জ্যেষ্ঠ নেতার ভাষ্য, সরকারের চারদিকে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং জাতিসংঘে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চিঠিতে সরকার দিশাহীন হয়ে পড়েছে। আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে বিশ্ববাসী আর গ্রহণ করবে না— তাও বুঝতে পেরেছে। এই নেতারা আরো বলেন, সরকারের একগুঁয়েমি কি কারো চাপের মুখে, নাকি নিজ থেকে— তা বোঝার চেষ্টা করছে বিএনপি। বিএনপি কোনোভাবেই ২০২৩ সালের নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো করে পার হতে দেবে না। এবারের নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে দলটি।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ