সম্প্রতি সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর থেকেই শুরু হয় দলটির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। ফলে বর্ষীয়ান নেতাদের সঙ্গে হাইকমান্ডের সম্পর্কে ঘটে অবনতি। দলের অন্দর মহলে ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে এ বিষয়টিকে সংগঠনের শৃঙ্খলা বাস্তবায়নে সাংগঠনিক ব্যবস্থা বলে অভিহিত করছেন দায়িত্বশীল নেতারা। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে, এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিএনপিতে বিদ্রোহ আসন্ন।
বিএনপির উচিত ধারণক্ষমতা বাড়ানো। অভিজ্ঞ নেতাদের সরিয়ে না দিয়ে বরং দক্ষ নেতাদের আরো বেশি জায়গা দেয়া। রদবদলের প্রক্রিয়ায় বিএনপি থেকে বাদ পড়েছেন দীর্ঘ দিনের পরিচিত অনেক মুখ। ফলে দলের ভেতরেই তৈরি হয়েছে গ্রুপিং। তাই দল থেকে বাদ, অব্যাহতি ও নোটিশ দেয়ার সংখ্যা বেড়ে চলছে। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এটা বুঝে করেছেন নাকি না বুঝে করেছেন, সেটা বোধগম্য নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, বিএনপি ধ্বংসের শেষ ধাপ শুরু হয়েছে এই রদবদল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, যেখানে বাদ দেয়া হচ্ছে দক্ষ ও অভিজ্ঞ নেতাদের। ফলে বিএনপিতে এখন প্রেজেন্টেবল নেতা নেই, যারা ছিলেন তাদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনে প্রার্থী সংকটে পড়বে।
তিনি বলেন, যদি তারেক রহমানের বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে দলের হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে এই বিক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা বিদ্রোহ তৈরি হতে পারে। অনেকেই হয়তো শেষ বয়সে এসে আরেকবার সংসদ সদস্য হওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন। পাশাপাশি যারা আগে মন্ত্রী-এমপি হয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, তারা তাদের সম্পদ রক্ষার্থে সরকারের সঙ্গেও আঁতাত করতে পারেন।দলীয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বিএনপি থেকে বেশ কয়েক বর্ষীয়ান নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পাশাপাশি অনেক নেতাকে দেয়া হয়েছে কারণ দর্শানোর নোটিশ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ঘটেছে বহিষ্কারের মতো ঘটনাও। সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের স্বাক্ষর করা এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলনকে একটি নোটিশে আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে মনোনীত করা হয়। এর আগে গত ২২ মার্চ আরেক নেতা বেলাল আহমেদকে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-দফতর সম্পাদক পদ থেকে সহ-গ্রাম সরকারবিষয়ক সম্পাদক পদে মনোনীত করা হয়। তারও আগে গত বছরে নভেম্বরে বরিশাল বিএনপির দীর্ঘদিনের কাণ্ডারি যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট মো. মজিবর রহমান সরোয়ারকে দলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। বরিশাল-৫ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য বরিশালে একক আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন।
২০১৮ সালে তিনি বরিশাল সিটির মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এছাড়াও গত বছরে খুলনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে। একই প্রক্রিয়ায় রাজশাহী মহানগর কমিটি থেকে বাদ পড়েন সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটিতে স্থান পাননি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সংসদ সদস্য হারুন অর রশিদের অনুসারীরা। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৈমূর আলম খন্দকারকেও সব পদ থেকে অব্যাহিত দেয় বিএনপি। আবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকেও দেয়া হয় দল থেকে অব্যাহতি। তবে এবারো সাক্কু সিটি নির্বাচনে বিএনপির কাছে মনোনয়ন চাইবেন। দল রাজি না হলে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন বলেও জানিয়েছেন। অপরদিকে দীর্ঘ ৬ বছর পর গত ২৯ মার্চ সিলেট জেলা বিএনপির কাউন্সিল হলেও কমিটিতে স্থান পাননি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ ত্যাগী নেতারা।
সূত্র আরো জানায়, ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মাধ্যমে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দলের সব পদবিসহ সাধারণ সদস্যপদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। একই বছর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত মাহবুবুর রহমান রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। এছাড়াও শমসের মবিন চৌধুরী ও এনাম আহমেদ চৌধুরীর মতো দুজন অভিজ্ঞ কূটনীতিকও হারিয়েছে বিএনপি। ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদকে কয়েক দফা কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে দলের হাইকমান্ড থেকে। একইভাবে বিব্রত করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকেও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন সম্পাদক বলেন, দলে যেভাবে রদবদল শুরু হয়েছে তাতে যদি সম্মানজনকভাবে রাজনীতি করতে না পারি তাহলে অনেকের মুখোশ খুলে দেবো। এই মুহূর্তে যে রদবদলগুলো হচ্ছে তা দলের জন্য আত্মঘাতী। সারাদেশে নেতাদের অপমান করা হচ্ছে। যদি এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে তাহলে রাজনীতি চলে যাবে ভিন্ন মাত্রায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, দলে পরিবর্তন একটা চলমান প্রক্রিয়া। পরিবর্তন হবে, হওয়াটা স্বাভাবিক, সেটা ঠিক আছে। তবে যাদের পরিবর্তন করা দরকার তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দেয়া হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য যারা আছেন তাদের পরিবর্তন করা হচ্ছে।
দলীয় সূত্রমতে, দল পুনর্গঠন নিয়ে ভীষণ ক্ষোভ বিরাজ করছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। অবমূল্যায়নের শিকার অনেকেই দলের প্রতি ক্ষুব্ধ। এদের মধ্যে এর আগে কেউ কেউ ছেড়েছে দল, কেউবা আবার দলীয় কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। ক্ষুব্ধ এসব নেতার অনেকেই বলছেন, কেউ কেউ দীর্ঘ তিন যুগ, কেউবা দুই যুগের বেশি সময় ধরে জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া তার আদর্শের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তাদের মধ্যে অনেকেই পাঁচ, ছয় কিংবা সাতবারও জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে একাধিকবার সিনিয়র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ দলে তুলনামূলক অনেক জুনিয়র নেতা বর্তমানে বারবার মূল্যায়িত, অতিমূল্যায়িত কিংবা সম্মানিত হচ্ছেন। আর ত্যাগী নেতারা দলীয় পদ-পদবিতে অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন। এতে নেতাকর্মীদের কাছেও এসব নেতা অসম্মানিত বোধ করছেন।
সূত্র বলেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বাদ দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন দলের ভেতরে কিছু নেতাকর্মী। এদের মধ্যে কয়েকজন চিহ্নিত। এছাড়াও সন্দেহের তালিকায় থাকা অনেকেই এখন আছেন নজরদারিতে। এর আগে ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময়ও শীর্ষ এই দুই নেতাকে বাদ দেয়ার দাবি উঠেছিল বিএনপির ভেতর থেকেই। তখন আলাদা কমিটিও করেছিলেন সংস্কারবাদী নেতারা। সেনা সমর্থিত তৎকালীন সরকারেরও পৃষ্ঠপোষকতা পেলেছিলেন তারা। তবে শেষ পর্যন্ত তারা সফল হতে পারেননি।
এ বিষয়ে ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু নয়া শতাব্দীকে বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তো থাকবেই। আমরা সচেতন আছি, দলের ভেতরে থাকা কোনো চক্রান্ত এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। কেউ অনিয়ম করে বা দলবিরোধী কার্যক্রম করে পার পাবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, দখলদার সরকার নিজেদের ঠেকিয়ে রাখতে এ সব খেলাধুলা করছে। কে গেল, কে এলো এতে বিএনপির কিছু আসে যায় না। বিএনপির শক্তি হলো জনগণের কাছে। অনেক বড় বড় নেতাও দল ত্যাগ করে সুবিধাভোগী হওয়ার জন্য এদিক সেদিক করেছে। তবে বিএনপির কোনো সমস্যা হয়নি।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপির নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমস্যা তো বিভিন্নভাবে দেখা দিয়েছে। এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতেই হয়, সে ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ