আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সাংগঠনিকভাবে চাঙা হওয়ার চেষ্টা করছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিও পুনর্গঠন করছে তারা। যুবদলের কমিটিও আসছে শিগগিরই। দ্রুত সংগঠিত হয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন ও সরকার পতনের আন্দোলনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে দলটি। ঠিক তখনই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া পুরোনো মামলা নিয়ে বিএনপিতে ফের দেখা দিয়েছে নতুন আতঙ্ক। নতুন করে মামলা দায়েরের পাশাপাশি পুরোনো মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমও এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। নাশকতার মামলায়ও অনেকেই ভুগছেন সাজা আতঙ্কে। চলতি ও আগামী বছরের জুনের মধ্যেই আসতে পারে এমন ৫ শতাধিক মামলার রায়। এতে প্রায় ৯০ শতাংশ বিএনপির নেতা বিভিন্ন মেয়াদে সাজার মধ্যে পড়ে যাবেন। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে ব্যাপক আতঙ্ক শুরু হয়েছে।
তবে নেতাকর্মীদের দাবি, আদালতে ন্যায়বিচার হলে এসব মামলার একটিও ধোপে টিকবে না। এভাবে হয়রানি করেও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা যাবে না জাতীয়তাবাদী শক্তিকে। সারাদেশে দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নামে কারণে-অকারণে আবারো নতুন করে মামলা দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন।
তারা মনে করছেন, ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকায় প্রশাসনে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে সরকার। তাই এখনো আন্দোলন দমনে পুরোনো পথই বেছে নেবে। বিরোধীদের কাবু করতে দ্রুত বিচার আইনে করা পুরোনো মামলাগুলোর দ্রুত বিচার শেষ করে সাজা দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এরই মধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে বেশ কিছু মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এসব রায়ে দলটির অনেক নেতা বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এখন জেলে। তাই জেলের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এ সরকারের বিরুদ্ধে সারাদেশের মানুষ জেগে উঠেছে। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হবে।
বিএনপি সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বেশ কয়েকটি পুরোনো মামলা সচল হয়েছে। এক মামলায় আটক হয়ে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন দলের তরুণ নেতা ইশরাক হোসেন। নয় বছর আগের অগ্নিসংযোগের এক মামলায় রাজধানীর মুগদার সাত বিএনপি কর্মীর দুই বছর করে সাজা হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসেও রাজধানীর একটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের এক মামলায় আরো ১০ নেতাকর্মীকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সারাদেশে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, মন্দির ও মূর্তি ভাঙচুর, নাশকতা, সরকারি কাজে বাধাদান, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলার কার্যক্রম চলছে দ্রুতগতিতে। ফলে জ্যেষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠ— দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। এসব মামলা দ্রুত শেষ করে আনতে তৎপর প্রশাসন। মামলার রায় হলে সাজা হলে উচ্চ আদালতে জামিন পাওয়ার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়বে। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়াও কঠিন হবে তাদের জন্য।
দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ মামলা ৩১৩টি। ইসহাক সরকার নয়া শতাব্দীকে বলেন, প্রতিদিন ৫-৭টা মামলার হাজিরা থাকে, সপ্তাহে পাঁচদিন কাটে আদালত চত্বরে। আদালতে হাজিরা দিয়ে এসে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেই।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী ১৯ মামলার আসামি। নয়া শতাব্দীকে বলেন, মামলা-হামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে আমাকে সরানো যাবে না। তিন মাস কারাগারে যে নির্যাতনের শিকার হয়েছি, দেশের কোনো দলের নারী নেত্রী এমন নির্যাতনের শিকার হননি। কারাগার থেকে বের হয়ে আবারো দলীয় কর্মসূচি পালন করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে ইসহাক সরকার এবং নিপুণ রায় জানান, চাপে রাখার জন্য এ ধরনের হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা দেয়া হয়েছে। মামলার বাইরে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের চাপ রয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শ যদি ঠিক থাকে, দলের প্রতি যদি অনুগত থাকা যায় তাহলেই চাপ আর চাপ মনে হয় না। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সবসময়ই প্রস্তুত থাকি।
বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদে আলোচনায় থাকা ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও নির্বাহী কমিটির সদস্য বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ ২২ মামলার আসামি। মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পরিহার করে ফ্যাসিজম চর্চা করছে, বিশেষ করে গত ১৪ বছর হামলা-মামলার মাধ্যমে বিএনপির গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে অগণতান্ত্রিকভাবে দমন করে নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছে। তবে তাতে সফল না হয়ে আগামী নির্বাচন ঘিরে তারা অনেক চক্রান্ত শুরু করেছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো সুনির্দিষ্টভাবে সাক্ষী না থাকা ভিত্তিহীন পুরোনো হয়রানিমূলক মামলাগুলোতে সাজা দিয়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এবং আগামী প্রজন্মের নেতাদের নির্বাচনের বাইরে রাখার হীন প্রচেষ্টা। আমরা এতে ভীত নই। আমরা রাজনৈতিকভাবে এবং আইনগতভাবে এসব মোকাবিলা করব। সর্বোপরি জনগণের আদালতে বিজয় সুনিশ্চিত।
দলটির দফতরের হিসাব অনুযায়ী, দেশব্যাপী মামলার আসামি হিসেবে বর্তমানে বিএনপি নেতাকর্মীর সংখ্যা ৩৬ লাখ ছাড়িয়েছে। মামলা রয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার। গত এক মাসেও ১৮ জেলায় মামলা হয়েছে অর্ধশতাধিক। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাইরে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে রয়েছে ৯১ মামলা, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের ৪৫, বেগম সেলিমা রহমানের ৫০, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ১৩, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলুর ১৩৬, উপদেষ্টা পরিষদের আমানউল্লাহ আমানের ৯১, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর শতাধিক, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ১৩০, হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের তিন শতাধিক, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের ১০১, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ১০৭টি, আসাদুল হাবিব দুলুর ৫৭টি, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফের ৪৭টি, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের ৮৬টি, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর ১৫৩টি ও যুবদল নেতা এসএম জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দেড় শতাধিক মামলা রয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, হয়রানি করার জন্যই মামলাগুলো দেয়া। সাজা দেয়ার ঘটনা বলে দেয় সরকার সেই অবস্থানেই আছে।
তিনি আরো বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যেসব মামলা দেখছি সেগুলো কোনোটা সাক্ষ্যগ্রহণ, কোনোটা অভিযোগপত্র দেয়ার পর্যায়ে আছে। আসলে মামলা এত বেশি যে কোনটা কোন অবস্থায় আছে বলা মুশকিল। তবে যাদের সাজা হবে তাদের জন্য রাজনীতি কঠিন হবে, এটাই স্বাভাবিক।
এ বিষয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতাদের অতিদ্রুত সাজা দিতে সরকার সেল গঠন করেছে।
এই সেল দিয়ে দ্রুত মামলাগুলো শেষ করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরকার বিভিন্ন জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের তালিকা তৈরি করছে। সেই তালিকা ধরে নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে সেগুলো দ্রুত শেষ করতে চাইছে।
তিনি বলেন, যে কোনো ইস্যুতেই বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে সরকার মামলা করছে, হামলা চালাচ্ছে। এসব মূলত সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা এবং স্বৈরতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য তথা নির্মূল করার জন্যই এই অপচেষ্টা।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ