আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কর্মসূচি ও কৌশল নির্ধারণের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে বিএনপি। দলের ভেতর-বাইরে চাপের মুখে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে দলটি। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়ার চাপ থাকলেও আমলে নেয়নি দলটি। তবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি এখন কিছুটা হলেও আত্মোপলব্ধি করছে বলে জানিয়েছে দলটির নীতিনির্ধারক মহল। নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে কোনো কর্মসূচি পালন করা হবে না। এ কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে দীর্ঘ ২২ বছরের জোটসঙ্গী জামায়াতকেও। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের এক নেতা দলের সিদ্ধান্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছেন, যে তারা জোটবদ্ধভাবে আর কোনো কর্মসূচি পালন করবেন না।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, জোটবদ্ধভাবে কর্মসূচি না দেয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের। এই সিদ্ধান্ত জামায়াতকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে প্রতিক্রিয়ায় ‘অনাপত্তি’ দিয়েছে জামায়াত। জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা জানিয়েছেন, ‘২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়া হয়েছে— এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জোট রান করবে না, এমনটিও বিএনপির তরফে বলা হয়নি। তবে, যার যার অবস্থান থেকে সরকার পতনের আন্দোলনের প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক কর্মসূচি দেয়ার বিষয়ে উভয় দল একমত হয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘বিষয়টা আনুষ্ঠানিক কিছু নয়। সরকারবিরোধী আন্দোলনে সফলতার জন্য কৌশলগত কারণে যেটা উত্তম সেটাই করবে জামায়াত। সেক্ষেত্রে যদি জোট সম্প্রসারিত হয় বা নিজ নিজ প্ল্যাটফর্মে থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনও হয়, তাতে আপত্তি নেই।’ এদিকে জামায়াত ছাড়ার দাবি জোরালো হচ্ছে বিএনপিতে। এরই অংশ হিসেবে বৈঠকেও দলে জামায়াত থাকায় লাভ-লোকসানের বিষয়টি তুলে ধরেন নেতারা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের কৌশল নির্ধারণে শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে একই কথা উঠে এসেছে। জামায়াতকে ত্যাগ করবে বিএনপি। আর এই সিদ্ধান্ত কেন নেয়া হয়েছে, তার কারণ উল্লেখ করে চিঠিও প্রস্তুত হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও জামায়াতকে ছাড়ার ব্যাপারে প্রস্তুত। তবে বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সংকেত পাওয়া যায়নি। দলের প্রধান দুইজন একই সিদ্ধান্তে আসতে পারলেই চূড়ান্ত হবে সবকিছু। বিএনপির নেতাদের জোর দাবি, জামায়াতের কারণে পশ্চিমা বিশ্বসহ ভারতকেও পাশে পাচ্ছে দলটি। আন্তর্জাতিক মহলেও দিন দিন বন্ধুশূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে দীর্ঘ ২২ বছরের জোটসঙ্গী স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে বের করে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বেশিরভাগ নেতাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, চলতি বছরের শুরু থেকেই বার বার স্থায়ী কমিটি থেকে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের প্রস্তাব করা হচ্ছিল। সেটা নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছিল। তবে জামায়াতকে নিয়ে আমরা আর এগোচ্ছি না। তারা তো শুধু ব্যবসা বোঝে, মুনাফা খোঁজে। তিনি আরো বলেন, আমাদের বয়স তো কম হয়নি। অনেক কিছু চাইলেও বলতে পারি না। দলের সেই স্পিরিট এখন নেই। তার একটা মূল কারণ মা-ছেলের দ্বন্দ্ব। জামায়াতকে ছাড়তে না পারার জন্যও এটাই মূল কারণ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বেগম খালেদা জিয়ার একক সিদ্ধান্তে আসতে না পারাই এর কারণ।
এদিকে, ২০ দলীয় জোট থেকে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে ইসলামি দলগুলো। সর্বশেষ বিএনপি জোট ছাড়ে কওমি আলেমদের পুরোনো দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। এর আগে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট ২০১৬ সালে বিএনপি জোট ছেড়ে যায়। আর শায়খুল হাদিসের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জোট ছাড়ে তারও অনেক আগে। বর্তমানে বিএনপি জোটে নিবন্ধিত একমাত্র ইসলামি দল মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস। দলের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে সহিংসতার মামলায় এখন কারাবন্দি। তাকে মুক্ত করতে দলের কেউ কেউ বিএনপি জোট ছাড়ার কথা ভাবছেন। কারণ জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিএনপির জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়ার পর দলটির নেতারা মুক্তি পান। তারাও একই পথে হাঁটতে চাইছে।
জানা গেছে, জামায়াতকে ছাড়ার ব্যাপারে বিএনপি এক ধাপ আগালে আরেক ধাপ পেছায়। জোট আর রাখা হবে না, এ বিষয়ে জামায়াতকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও আর এতদিন ধরেও এগোতে পারেনি বিএনপি। সরকার পতনের আন্দোলনে গঠিত ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যজোট’ জামায়াত থাকলে অনেকেই আসতে চাইছেন না। বর্তমানে জোট গঠনের খসড়া রূপরেখাও তৈরির কাজ চলছে। তবে রাজপথের আন্দোলনে বিএনপিকে পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছে জামায়াত। এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী অতীতে ছিল, এখনো আছে ও ভবিষ্যতেও থাকবে। যদিও বিএনপি-জামায়াত একে অপরকে এড়িয়ে চলছে। জামায়াতের সেক্রেটারিসহ শীর্ষ ৯ নেতা গ্রেফতার হলে বিএনপির বিবৃতিও তাদের একদম পছন্দ হয়নি। মূলত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। সিরিজ বৈঠকের অংশ নেয়া দলের একাধিক নেতা জানান, জামায়াত ছাড়ার দাবি তোলার পরে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালে যোগ দেয়া তারেক রহমান কোনো যুক্তি খ্লন করেননি; বরং এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে সংকেত পাওয়া গেলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন। তিনি এ বিষয়ের জন্য প্রস্তুত আছেন। বিএনপি নেতারা জানান, দলের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে জামায়াত ত্যাগের পেছনে তিনটি যুক্তি তুলে ধরেছেন নেতারা। প্রথমত- জামায়াতকে ছাড়তে পারলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি প্রধান প্রতিবেশী ভারতকেও আস্থা পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত- বিএনপির সঙ্গে জামায়াত না থাকলে উদার ও বামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গঠন করা যাবে; যাদের নিয়ে আগামী নির্বাচনের আগে বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে চায় বিএনপি। তৃতীয়ত- দলের বিরুদ্ধে ‘খালেদা-নিজামী’ বা ‘বিএনপি-জামায়াত’ বলে আওয়ামী লীগ নেতারা নেতিবাচক প্রচার চালায় তাও দূর করা যাবে।
অবশ্য দলটির নেতারা এও বলছেন, বৈশ্বিক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতি থেকেও বিএনপির ফায়দা নেয়ার সুযোগ আছে। ওই ঘটনার পর ইসলামপন্থি শক্তির উত্থানের আশঙ্কায় এ অঞ্চলের দেশগুলো নতুন করে হিসাব-নিকাশ কষছে। ফলে ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে অগ্রসর হতে চাইছে বিএনপি। তাদের মতে, ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলার কারণেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে। তাই জামায়াতকে এখনই দূরে রেখে বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি বলেও মনে করছেন তারা।
দলীয় সূত্রমতে, চলতি বছরের শুরুর দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সভায় জামায়াত ছাড়ার প্রস্তাব রাখা হয়। সে সভায় ভার্চুয়ালে যুক্ত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। সেখানে জামায়াতকে জোটে রাখা নিয়ে বিএনপির লাভ-লোকসান নিয়ে রীতিমতো তর্ক-বিতর্কও হয়। ওই বৈঠকে তিন নেতা খন্দকার মোশারফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জামায়াতকে বের করে দেয়ার পরামর্শ দেন। তাদের পরামর্শে তারেক রহমানের সমর্থন ছিল। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন থেকেই ছাড়ার সিদ্ধান্তটি ঝুলে রয়েছে। তবে এরপর গত ৪ সেপ্টেম্বর শনিবার দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জামায়াতকে দূরে রাখার বিষয়ে নতুন করে আলোচনা হয়েছে। এরপর চলমান ছয় দিনব্যাপী সিরিজ বৈঠকে নির্বাহী কমিটি সদস্য, তৃণমূল ও জেলা কমিটির সদস্য এবং আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনাও জামায়াত ছাড়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বেশিরভাগ নেতাই।
জানা যায়, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে ইসলামি মূল্যবোধ রাজনীতিতে অনেকটা এককভাবে ব্যবহার করত এবং এর সুবিধা পেত বিএনপি। বর্তমানে এখন সে পরিস্থিতি নেই। বিশেষ করে বিএনপির জোটসঙ্গী হিসেবে হামলা মামলা থেকে দূরে থাকতেই বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করছে ইসলামি দলগুলো। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মহলে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ধারণা কাটাতে বিএনপি কয়েক বছর ধরে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। জোটের রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না এমন অভিযোগও রয়েছে। ফলে ইসলামি দলগুলোর অনেকে বিএনপি জোট থেকে সরে যায়। তবে ২০ দলীয় জোটে যারা রয়েছে তারা দলগুলোর খ্লিত অংশ। তবে বিএনপি থেকে ছেড়ে যাওয়া দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সখ্য বাড়ছে। অন্যদিকে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামির নিবন্ধন নেই। বর্তমানে বিএনপির সম্পর্ক এখন ততটা সাবলীল নয়। বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতকে ছাড়ার জন্য দলে চাপ রয়েছে। জানতে চাইলে বিএনপির ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি’-এর সদস্য শামা ওবায়েদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকা না থাকার বিষয়ে দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবে। এটা নিয়ে নেতারা তাদের পারসেপশন জানিয়েছেন। মাঠপর্যায়ের নেতাদেরও একটা দাবি বারবার আসছে। তবে সেটার সিদ্ধান্ত এখনো নেয়া হয়নি। জামায়াতকে ছাড়লে বিএনপি লাভবান হবে কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লাভ-লোকসান ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে বৈশ্বিক রাজনীতির পাশাপাশি তালেবানের উত্থানের পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন রাজনীতির সঙ্গে অবশ্যই আমাদের সমন্বয় করতে হবে।
জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমরা আমাদের নেতাকর্মীদের নিয়ে হাইকমান্ডের সঙ্গে বসছি। বাতাসে খবর ওড়ে। উড়ো হোক আর সঠিক হোক, সময়মতো জানবেন।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের বাইরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েক শীর্ষনেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, গত কয়েকমাস ধরে বিএনপির সঙ্গে যেসব দলগুলোর আলোচনা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই জোটহীন কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও ‘যুগপৎ’ কর্মসূচির পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত, ডান-বাম ও মধ্যপন্থি দলগুলোকে একমঞ্চে আনার ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা রয়েছে, ‘যুগপৎ’ কর্মসূচি হলে তা থাকবে না, বলে জানিয়েছে ঐক্যে আগ্রহী দলগুলো। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালেও কয়েক নেতা বিষয়টি স্বীকার করেন।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ