রাজনীতিতে মিলছে নতুন ষড়যন্ত্রের আভাস। নির্বাচনের ২১ মাস বাকি থাকলেও এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে হিসাব-নিকাশের খেলা। এক পক্ষের কাছে খেলার নাম ‘নির্বাচনকালীন সরকার’— আরেক পক্ষের কাছে ‘জাতীয় সরকার’। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, নির্বাচনকালীন সরকার বা নির্বাচন-পরবর্তী জাতীয় সরকার ঘিরে ষড়যন্ত্রকারীরা এক জোট হলে তা হবে ওয়ান-ইলেভেনের পর আরেকটি রাজনৈতিক বিপর্যয়। তাই সরকার ও বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক শীর্ষ নেতাদের থাকতে হবে সতর্ক। ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ বা ‘জাতীয় সরকার’ আড়ালে অরাজনৈতিক কোনো পক্ষের হাতে যেন রাজনীতি বন্দি হয়ে না হয়ে পড়ে— রাজনীতিকদের এখন থেকেই তা নিয়ে কাজ করা উচিত।
জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন চাঞ্চল্য। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে নানা তৎপরতা। কোনো কোনো দলের দাবি, আগামী নির্বাচন হোক জাতীয় সরকারের অধীনে। আবার কারো কারো দাবি— আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। পরে জাতীয় সরকার গঠন। এই ইস্যুতে পরবর্তী অন্তত ৬ মাস দেশের রাজনীতির মাঠ গরম থাকার আভাস মিলছে। তবে জাতীয় সরকার ইস্যুটি এক ধরনের রাজনৈতিক ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। ফর্মুলাটিকেও অনেকেই বলছেন, নতুন কাঠামোয় পুরোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এর পেছনের কলকাঠি নাড়ছে দেশ-বিদেশের একটি বিশেষ মহল। তাদের উদ্দেশ্য— ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন সরকারের মতো আরেকটি সরকার গঠন করা। তাই জাতীয় সরকার গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সর্তক থাকতে হবে যেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে না যায়। তাদের হাতে ক্ষমতা গেলে আরেকটি রাজনৈতিক দুর্যোগের দিকে ধাবিত হবে দেশ। আবারো সক্রিয় হতে পারে ওয়ান-ইলেভেনের সময় ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা সঙ্গে জড়িতরা। তাই নির্বাচনের আগে ‘জাতীয় সরকারে’র ভয়ংকর প্রস্তাবে রাজি হলে রাজনীতি নেমে আসতে পারে কালো মেঘ। বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসা জাতীয় সরকারের দাবি নিয়ে আরো ‘চিন্তা-ভাবনা’ করা উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) এ কে মোহাম্মদ আলী সিকদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘সংবিধানে জাতীয় সরকারের কোনো বিধান নেই। কেনো নামও নেই, সংজ্ঞাও নেই। আপাতত দৃষ্টিতে জাতীয় সরকার গঠনের কোনো সুযোগ নেই। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা দেখেছি, সব রাজনৈতিক দল একজোট হলে সংবিধানে না থাকলেও অনেক কিছু সংযোজন বা সংশোধন হয়। এটা আলাদা বিষয়। ভবিষ্যতে কি হবে না তা পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে জাতীয় চার নেতা ও ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো বহু ধরনের ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন সময়েই দেখেছি। সেই ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশের একটা রূপ দেখেছি ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। একটা সরকার এলো, আর তারা জরুরি অবস্থা জারি করলো অনির্দিষ্টকালের জন্য। তাদের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ ছিল তিন মাস।’ তবে সেই সময়ে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞরা বললেন, ‘জরুরি অবস্থার কারণে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা নেই। বড় ষড়যন্ত্র তখন হয়েছিল। তাই ওয়ান-ইলেভেন সরকারের মতো যদি কেউ জাতীয় সরকারের আড়ালে ষড়যন্ত্র চিন্তা-চেতনা করেন- তাহলে অবশ্যই সেটা ষড়যন্ত্র হবে।’
একে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ‘ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেগে আছে, থাকবে, আগামীতে হবে। এই ষড়যন্ত্রের মূলভীতি হচ্ছে বাংলাদেশে যেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চিন্তা চেতনার রাজনীতি ও রাষ্ট্র যেন সুপ্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। বাস্তবায়নের জন্য বহু সময়ে বিভিন্ন নামে, কায়দায় ও কৌশলে এই ষড়যন্ত্র হয়েছে। যার একটি হলো ২০০৭-০৮। তাই আগামীতে কি ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা সময়েই বলে দেবে।’
তিনি বলেন, ‘পার্লামেন্টে হেড অব হাউস যদি চান তাহলে অনির্বাচিত কাউকে মন্ত্রী বানাতেন পারবেন। কারণ সংবিধানের ১০ শতাংশ মন্ত্রী নির্বাচিতদের বাইরে থেকে দিতে পারবেন। সেই হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সম্পূর্ণ এখতিয়ার রয়েছেন মন্ত্রিসভায় তিনি কাকে নেবেন আর নেবেন না। এটা হচ্ছে বিষয়। তাই যারা জাতীয় সরকার নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন তাদের লক্ষ্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা।’
‘জাতীয় সরকার’ ফর্মুলাকে আমলেই নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কিছুতেই সংবিধানের বাইরে যাবে না আওয়ামী লীগ। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা শতভাগ অনুসরণের মধ্য দিয়েই তারা সামনের সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম গুছিয়ে আনবে। পবিত্র সংবিধানের ভেতরে থেকেই বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এ নিয়ে অহেতুক রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। তাই দুষ্টচক্রের রাজনৈতিক ধুম্রজাল, অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র শক্তভাবেই মোকাবিলা করা হবে। বিএনপি জাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য জাতীয় সরকারের কথা বলছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বিএনপি কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলে, কখনও বলে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের কথা। আসলে তারা সংবিধান বোঝে না। সংবিধান বুঝতেও চায় না। আসলে তারা কী চায়, সেটা নিজেরাও বোঝে না। তারা নেতৃত্বহীন অবস্থায় রয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপির দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা অসম্ভব। সংবিধানে এটা নেই। নির্বাচনে বিজয়ী হলে তারা কী করবে, এসব বলছে বিএনপি। তারা যে নির্বাচনে জয়ী হবে, এই গ্যারান্টি তাদের কে দিয়েছে? আসলে তারা অবান্তর ও অবাস্তব কথা বলছে। জনগণের জন্য যা কিছু করার প্রয়োজন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তার সবকিছুই করবে আওয়ামী লীগ।
ভোটের পর বিজয়ী হলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে জানিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছে— নির্বাচনে জয়ী হলে এককভাবে নয়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে বিএনপি। সেই সরকারে রাজনীতিকদের বাইরে, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ পেশাজীবীরাও থাকবেন। দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে সরকার। তাই সকলকে নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করতে চায় বিএনপি, নিশ্চিত করতে চায় গণমানুষের অধিকার।
জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, সমস্যা হলো রাষ্ট্রীয় সব কাঠামোকে সরকার দখল করে ফেলেছে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া তো কোনো সংস্কার বা পরিবর্তন আনার কোনো অধিকার কারো নেই। তাই দেশে যে পরিবর্তনগুলো আনতে হবে সেগুলো জনসম্মক্ষে আমরা তুলে ধরব। আগামী নির্বাচনে গণতন্ত্রের পক্ষে যারা থাকবে, নির্বাচনে জয়ী হলে তাদের নিয়ে তখন একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। রাষ্ট্র সংস্কারে অনির্বাচিত সরকারের কোনো সাংবিধানিক অধিকার নেই। তাই প্রথমে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় বিএনপি। জাতীয় সরকার গঠন করতে চায় জয়ী হওয়ার পর।
তিনি বলেন, জাতীয় সরকারে সমমনা বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণ থাকবে, তার আগে মৌলিক দাবিতে অভিন্ন লক্ষ্যে হবে আন্দোলন। রাজনীতিবিদদের বাইরে থাকবে সুশীল সমাজসহ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সবাইকে নিয়েই জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। শুধু যে রাজনীতিবিদরাই থাকবেন তা না যারা কমিটেড থাকতে পারবেন তারা সবাই অংশগ্রহণ করবেন।
বিএনপির নেতারা বলছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জাতীয় সরকারের ধারণাটি হলো, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। এ লক্ষ্যে যে আন্দোলন হবে সে আন্দোলনে যারা থাকবেন তারা নির্বাচনে বিজয়ী না হলেও তাদের সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। নির্বাচিত হলে আন্দোলনে থাকা সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠন করা হবে জাতীয় সরকার। শীর্ষ নেতৃত্বের এমন ধারণাকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
জানতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘‘আমরা তো সব সময় বলে আসছি দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। আমরা দেখেছি নিরপেক্ষ সরকারের নামে বিভিন্নভাবে দলীয় লোকদের বসিয়ে কাহিনি করা হয়। এটা বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের আমলে হয়েছে। এজন্য আমরা বলেছি সব দলের মতামত নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করার। আর পার্লামেন্ট রেখে দেশে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ