অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর কোনো উদ্যোগ নেই বিএনপির। দলটির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থাকলেও শুধু নতুন কমিটি পেয়েছে জাতীয়তাবাদী কৃষক দল। বাকি ১০ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। এরই মধ্যে অনেক সংগঠনের কমিটিরও মেয়াদ ৬-৮ বছর অতিক্রম করলেও সম্মেলনের কোনো উদ্যোগ নেই। কোনো কোনো সংগঠন মেয়াদ পূর্ণ করলেও এখনো কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। আবার পুনর্গঠনের জন্য নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেয়ার পর কমিটি দিতে ব্যর্থ হয়েছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। ফলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে এসব সংগঠন। দলীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, কৃষক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, ওলামা দল, জাসাস, মৎস্যজীবী দল এবং তাঁতী দল হলো অঙ্গ সংগঠন। বিএনপির সহযোগী সংগঠন হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং শ্রমিকদল। এর মধ্যে যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ আড়াই বছর আগে। তিন বছর আগে মেয়াদ শেষ হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দলের। ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্ব বাছাই করলেও তারাও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেননি। তাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ৬ মাসের বেশি। তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটিতেই তিন বছর পার করেছে মৎস্যজীবী দল ও ওলামা দল। মহিলা দলের কমিটিরও বয়স ৬ বছর ও মুক্তিযোদ্ধা দলের ৮ বছর। আর কমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদের একক দখলে তাঁতী দল। এদিকে, সম্প্রতি কৃষক দলের পুর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সব কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। কয়েকদিন আগে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) এর কমিটি ভেঙে আহ্বায়ক কমিটি দেয়া হয়েছে। এসব সংগঠনের অধিকাংশ মেয়াদহীন হলেও এ বিষয়ে ভ্রূক্ষেপ নেই বিএনপির হাইকমান্ডের। নতুন কমিটি এবং আংশিক কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা।
এসব দাবিতে দলীয় কার্যালয় ভাংচুর, অনশন, মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছে কমিটিতে স্থান না পাওয়া নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দল পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনগুলোও ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কয়েক মাস আগে ঘোষণা করা হয়েছে কৃষক দলের কমিটি। পর্যায়ক্রমে মেয়াদোত্তীর্ণ সব কমিটিই নতুন করে সাজানো হবে।
তিনি আরো বলেন, কমিটি পুনর্গঠনে যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে এবং হবে। বিগত সময়ে হামলা-মামলা মোকাবিলা করে যারা রাজপথে ছিলেন, তারাই অগ্রাধিকার পাবেন। কারণ সামনে আমাদের কঠিন সময়। তাই আন্দোলনমুখী নেতৃত্বকেই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছি। আশা করছি, চলতি বছরেই সব অঙ্গ সংগঠন সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি দেয়া হবে। সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মকৌশল নির্ধারণে গত বছর দলের বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে অঙ্গ সংগঠনের পুনর্গঠন বিষয়ে দাবি তুলেছেন বেশিরভাগ নেতা। তারা বলেছেন, আন্দোলনকে সফল করতে যোগ্যদের হাতে নেতৃত্ব দিতে হবে। রাজপথের পরীক্ষিতদের সামনে আনতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ সব সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশিরভাগ নেতা। এমনকি অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের অনেকেও নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে দাবি তুলেছেন।
যুবদল: এ কমিটি ৬ বছরে পদার্পণ করেছে। সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় এক মাস পর কমিটি দেয়া হলেও তাও আবার আংশিক। ১১৪ সদস্যের আংশিক কমিটিকে এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারেননি। যুবদলের কমিটি নিয়ে দুই ধরনের মত রয়েছে। এক অংশ চাচ্ছে যুবদলের আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সুযোগ দেয়া হোক। অন্য অংশ চাচ্ছে নতুন কমিটি।
স্বেচ্ছাসেবক দল: ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর প্রয়াত শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদির ভুইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষেরও এক বছর পর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালে শফিউল বারী বাবু মারা যান। এরপর হতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিয়ে চলছে এ সংগঠনটি। এ কমিটির মেয়াদ পাঁচ বছর অতিক্রম হতে চলছে।
ছাত্রদল: ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিন মাস পর ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এ কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার জন্য পদবঞ্চিরা একাধিকবার বিক্ষোভ, অনশনসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে আসছে। এই বিষয়েও বিএনপির উচ্চমহল কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি বলে পদবঞ্চিতদের অভিযোগ।
মহিলা দল : ছয় বছর অতিক্রম হতে চলছে মহিলা দলের কমিটি। আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মহিলা দলের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে ২০২০ সালের ৪ এপ্রিল তা পূর্ণাঙ্গ করা হয়। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বেশ সমালোচিত এ সংগঠন। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের কমিটিসহ কয়েকটি জেলা কমিটি নিয়ে ব্যাপক তোপের মুখে পড়েন মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে আফরোজা আব্বাসের অব্যাহতি ও ঘোষিত কমিটিকে ‘কাজের বুয়া কমিটি’ আখ্যা দিয়ে দলের নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন মহিলা দলের নেতাকর্মীরা। যারা এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন, পরের দিনই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
জাসাস: গেল বছর ৬ নভেম্বরে জাসাসের নতুন আহ্বায়ক কমিটি দেয়া হয়। এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এতে চিত্রনায়ক হেলাল খানকে আহ্বায়ক ও জাকির হোসেন রোকনকে সদস্য সচিব করা হয়। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি দিয়েছেন তারা।
মৎস্যজীবী দল: ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ১০ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ মৎস্যজীবী দলের কমিটিকে ভেঙে সংগঠনের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মাহতাবকে আহ্বায়ক ও আব্দুর রহিমকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এতে ২৩ জন যুগ্ম-আহ্বায়কসহ ১২৯ জন সদস্য নিয়ে সর্বমোট ১৫৪ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন মাসের জন্য দেয়া এই আহ্বায়ক ইতোমধ্যে তিন বছর পার করেছে।
ওলামা দল: মেয়াদহীনভাবে চলছে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ওলামা দলও। দোয়া আর মিলাদ দিয়েই পার করছে বছরের পর বছর। ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহ মো. নেছারুল হককে আহ্বায়ক এবং মাওলানা নজরুল ইসলাম তালুকদারকে সদস্য সচিব করে ১৭১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন করার নির্দেশনা থাকলেও এখন আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে এই সংগঠনটি।
মুক্তিযোদ্ধা দল: প্রায় আট বছর মেয়াদ অতিবাহিত হতে চলছে এই সংগঠনটির। ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর ইশতিয়াক আজিজ উলফাতকে সভাপতি এবং এম এম শফিউজ্জামান খোকনকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৯১ সদস্য কমিটি গঠন করা হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধা দলের নিজস্ব কোনো কর্মসূচি নেই বলেই জানান নেতাকর্মীরা।
তাঁতী দল: দীর্ঘ ১১ বছরের কমিটি ভেঙে ২০১৯ সালে ৬ এপ্রিল আবুল কালাম আজাদকে আহ্বায়ক ও মজিবুর রহমানকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি দেয়া হয়। এই কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন করার কথা বলা হলেও চলছে এই আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই। অভিযোগ রয়েছে কমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদের একক দখলে তাঁতী দল।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ