রাজনীতিতে এসে দারুণ আলোচিত তরুণ প্রজন্ম। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে সরাসরি অংশগ্রহণ ও প্রাণবন্ত বক্তব্য ‘দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিবিদ’ হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে তরুণ রাজনীতিবিদদের। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে অথবা নিজ দলের ব্যানারে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশও নিয়েছেন তারা। কেউ নির্বাচিত হয়েছেন, আবার কেউবা বরণ করেছেন পরাজয়। নির্বাচন-পরবর্তীতেও তাদের প্রায় সবাই রাজনীতির মাঠে রয়েছে সরব উপস্থিতি। উন্নয়ন কিংবা আন্দোলন স্ব স্ব ক্ষেত্রে রাখছেন সফলতার স্বাক্ষর।
রাজধানী ঢাকার রাজনীতি এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে। পিতাদের পর রাজনীতির মাঠে নেমেছেন ছেলেরা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচনে একটি ব্যতিক্রম বাদে জমে উঠেছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের নির্বাচনী লড়াই। আর সেই থেকেই জায়ান্ট পলিটিশিয়ানদের এসব পুত্র শক্ত অবস্থানে থেকে রাজধানীতে নিজ নিজ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতি প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জুর ছেলে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। পিতার হাতে গড়া দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)—এর বর্তমান চেয়ারম্যান তিনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ব্যানারে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। ভোলা-১ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এরপর একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে ঢাকা-১৮ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু পরাজিত হন। বিএনপির সংসদে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে পার্থের দল বিজেপি। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের কড়া সমালোচক পার্থ। সংসদে ও টক শোতে বিভিন্ন সময় নানা ইস্যুতে বক্তব্য দিয়ে দারুণ আলোচিত হয়ে ওঠেন নতুন প্রজন্মের এ রাজনীতিক। আন্দালিব রহমান পার্থ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এ ভয়কে জয় করতে হবে। দুর্নীতির মহামারি কিংবা অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। দুর্নীতি সব মানবিক মূল্যবোধকে শেষ করে দেয়। কিন্তু তাই বলে আমরা তরুণ প্রজন্ম ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কর্তব্য থেকে সরে থাকতে পারি না। যেহেতু কোনো কার্যকর সরকারের অস্তিত্ব নেই, সেহেতু বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার কথা বলা অর্থহীন।’
তিনি বলেন, ‘আমলারা রাজনীতি খেয়ে ফেলেছে। বিরোধী দলের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। আসলে ৩০০ আসনে ছোট ছোট ৩০০ রাজা বসে আছে। যার যেমন ইচ্ছা দেশ চালাচ্ছে। বর্তমানে রাজনীতিতে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যে শূন্যতা বিরাজ করছে তা পূরণ করতে এগিয়ে আসতে হবে নতুন প্রজন্মকে। যদি তারা বর্তমানকে রূপদান না করতে পারে তাহলে তাদের এবং এ দেশের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে না। তরুণদের উপলব্ধি করতে হবে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিরাট আশা ধ্বংস হতে বসেছে। তাই তাদের তারুণ্যের শক্তি ও উদ্দীপনাকে ব্যবহার করতে হবে, রাজনীতিতে সম্মান ও মর্যাদাবোধ এবং নিঃস্বার্থ জনসেবার আদর্শ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনে পরিবর্তন আনতে হবে।’
ঢাকার রাজনীতিতে পারিবারিক প্রভাবের বিষয়টিকে ছাপিয়ে যে কথাটি গুরুত্বের সঙ্গে সামনে চলে এসেছে, তা হলো নতুন প্রজন্মের উত্থান। অর্ধ-শতাব্দী প্রাচীন রাজধানী শহরকে ঐতিহ্যের সমন্বয়ে সর্বাধুনিক সুবিধা ও কাঠামোতে গড়ে তুলতে নতুন প্রজন্মের বিকল্প নেই। নতুন প্রজন্মই পারে সুদূরপ্রসারী কর্মকুশলতায় ঢাকার নববিকাশকে ত্বরান্বিত করতে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘তরুণদের উন্নয়ন কর্মে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে জায়গা করে দিচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে গেলে এই বিশাল তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে নিয়োজিত করতেই হবে। ভবিষ্যতে তারা কী ধরনের কর্মে নিয়োজিত হবেন, তরুণদের জন্য কী সুযোগ আছে এবং কী ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করবে তা শুধু আওয়ামী লীগ অনুধাবন করতে পেরে রাজনীতিতে তরুণদের বিশাল একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করা। তরুণরা দেশের সার্বিক কল্যাণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, উৎকর্ষ সাধনের সাধক, উন্নয়নের ধারক-বাহক ও চালক হিসেবে বিবেচিত হবে সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে।’
সাঈদ খোকন আরো বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম বর্তমানের নায়ক আবার ভবিষ্যতের নির্মাতাও। তাই তাদের জেগে উঠতে হবে, নেতৃত্ব দিতে হবে। স্বপ্নকে সার্থক করতে এগিয়ে আসতে হবে তরুণ রাজনীতিবিদদের। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির মধ্যে কোনো মর্যাদাবান জাতি বেঁচে থাকতে পারে না।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গত নির্বাচনে সাবেক মেয়র হানিফপুত্র ও সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন দলীয় মনোনয়ন দৌড়ে ছিটকে পড়লেও ভোটের মাঠে মুখোমুখি ছিলেন দুই জায়ান্ট পলিটিশিয়ানের পুত্র। একজন স্বাধীনতা-পরবর্তী যুব রাজনীতির শীর্ষনেতা শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপস, তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে হয়েছেন নির্বাচিত। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ভোটের মাঠে ছিলেন সাবেক মেয়র ও রাজনীতিবিদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন। উত্তরে বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম আওয়ামী লীগ থেকে পুনরায় মনোনয়ন পেলেও বিএনপি থেকে প্রার্থী করা হয়েছিল ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ আবদুল আউয়াল মিন্টুর পুত্র তাবিথ আউয়ালকে।
অর্থাৎ একমাত্র মেয়র আতিক ছাড়া অন্যরা পৈতৃক রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের কারণে আলোচিত। এই আলোচনায় যেমন আছে রাজনীতিকে পারিবারিকীকরণের কথা, তেমনি আছে রাজনীতিতে দ্বিতীয় প্রজন্মের উত্থানের তথ্য ও ঢাকার ভাগ্য আর ভবিষ্যতের বিষয়সমূহ।
উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত হন নি বলে দাবি করে ইশরাক হোসেন নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘রাজনীতি হচ্ছে শাসন করার বুদ্ধিমত্তার আলোকিত প্রক্রিয়া। সেখানে ব্যক্তির খেয়াল-খুশির কোনো জায়গা নেই। রাজনীতি বলতে কী বোঝায়, সে সম্পর্কে দার্শনিক প্লেটো থেকে শুরু করে রুশো এবং আরো অনেকের শিক্ষাই আমরা লাভ করেছি। দুর্বৃত্তপনা, প্রতারণা, দুর্নীতি তথা জনগণের অর্থ লুটপাট করাকে রাজনীতি বলে না। একজন রাজনৈতিক নেতার যেমন গভীর জ্ঞান থাকতে হয়, তেমনি থাকতে হয় জনগণের প্রতি প্রবল দায়িত্ববোধ। আর সেই দায়িত্ববোধ থেকেই জনসেবার জন্যই রাজনীতিতে নিজেকে জড়িয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাবাকে (বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা) দেখেছি কীভাবে জনসেবা করতে হয়। আবার কীভাবে দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। আর সেসব শিক্ষাই আমার প্রেরণা হিসেবে আজ কাজে লাগছে।’
ইশরাক আরো বলেন, ‘স্বাধীনতার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের মুক্তিযুদ্ধে রূপদান করতে হবে। এ সত্য সম্পর্কে যারা উদাসীন তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে না। নতুন প্রজন্ম হবে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার মুক্তিযোদ্ধা। হংকংয়ের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা রক্ষার জন্য তারা সামনে এগিয়ে গিয়েছে; পেছনে ফিরে তাকায়নি কিংবা অগ্রজদের নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষা করেনি।’
ফজলে নূর তাপস ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ ফজলুল হক মনি ও মাতার নাম আরজু মনি। তিনি ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যের ওলভারহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনবিদ্যায় স্নাতক (এলএলবি) সম্পন্ন করেন। ১৯৯৭ সালে ‘বার অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস’-এর জেনারেল কাউন্সিলের অধীনে বার ফাইনাল কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি লিংকস্ ইন ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের একজন সদস্য। তাপস শৈশবে বাবাকে হারিয়ে পিতার সরাসরি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। সংগ্রাম ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তিলে তিলে নিজের পেশাগত ক্যারিয়ার ও রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলতে হয়েছে তাকে। আইনজীবী সমাজের নেতৃত্বের পাশাপাশি তিনি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসদ সদস্যের পদ ছেড়ে একটি পরিকল্পিত ও অগ্রসর রাজধানী গড়ে তোলার প্রত্যয়ে তিনি দক্ষিণ সিটির মেয়র হওয়ার চিন্তা করেন। ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ আসনের সংসদ সদস্য রূপে তাপস নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন, সেসব উত্তরণের জন্য মেয়র পদে আসতে চাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ উত্তরের কর্মমুখী মেয়র আতিকের পাশাপাশি দক্ষিণে তাপসকে মনোনয়ন দিয়ে একটি চৌকস টিম উপহার দেয় ঢাকাবাসীকে, যারা একবিংশ শতকের উপযুক্ত একটি রাজধানী গড়তে সফল হবেন বলে আশা আওয়ামী লীগের। বিএনপিও তেমন ভাবনা থেকে ইশরাক-তাবিথ জুটিকে সামনে নিয়ে আসে। পিতার পথ ধরে রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করছেন তারাও।
অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ও ইসমত হোসেনের বড় ছেলে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন। তিনি ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল শেষ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ইউনিভার্সিটি অব হার্টফোর্ডশায়ারে (যুক্তরাজ্য) যান। সেখানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন, মাস্টার্স শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবীদ আবদুল আউয়াল মিন্টু ও নাসরিন ফাতেমা আউয়ালের ছেলে তাবিথ মোহাম্মদ আউয়াল। ১৯৭৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গুলশানের আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে ‘এ’ ও ‘ও’ লেভেল পাস করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতক এবং তথ্য ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর করেন। বাবা আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রতিষ্ঠান মাল্টিমোড গ্রুপে কাজ করছেন তিনি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন তাবিথ।
দেশের জায়ান্ট পলিটিশিয়ানদের পুত্রগণ রাজনীতির পাশাপাশি ঢাকা বাঁচানোর এবং বিকশিত করার ভূমিকায় রয়েছেন মাঠে। তাদের নতুন নেতৃত্বে শুধু রাজনৈতিক ভাগ্যই নির্ধারিত হবে না, ঢাকার ভবিষ্যতও নিরূপিত হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ