ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

হার্ডলাইন কর্মসূচি চায় তৃণমূল বিএনপি

প্রকাশনার সময়: ২২ মার্চ ২০২২, ০৯:২৮

দলের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও আপাতত শান্তির পথে থাকতেই চায় বিএনপি। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করার পক্ষে দলের হাইকমান্ড। সময় নিয়ে কঠোর কর্মসূচিতে যেতে চায় দল। তবে গতানুগতিক কর্মসূচির পরিবর্তন চায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকে। তবে তৃণমূলের নেতারা বর্তমান শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বিপক্ষে। এখনই হার্ডলাইনে যাওয়ার পক্ষে তারা।

তাদের মতে, সরকার পতন চাইলে হরতাল, অবরোধ ও অবস্থানের মতো সর্বাত্মক কর্মসূচি নিয়ে নীতি-নির্ধারকদের ভাবা উচিত। তারা বলছেন, নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা নিয়ে কখনোই দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই সরকার পতনের ‘এক দফা’ দাবি আদায়ে কঠোর কর্মসূচি নিতে হবে এখনই। বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা ও তৃণমূলের নেতারা বলছেন এমন কথা।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ, অনশন আর মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকলেও আন্দোলন বেগবান করতে পারছে না বিএনপি। তাই এগুলোকে আর দাবি আদায়ে যথার্থ মনে করছেন না নেতাকর্মীরা।

অবশ্য তারা এও বলছেন, এখন কঠোর কর্মসূচি দিলেই সংঘাত ও সহিংসতা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এতে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা নতুন করে মামলা-হামলায় আবার ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাধা পড়তে পারে সরকার পতনের আন্দোলন ও বৃহত্তর জোট গঠন প্রক্রিয়ায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের বৃহত্তর আন্দোলনের ভিত রচনা হবে বলে মনে করেন তারা।

দলের কট্টরপন্থী জ্যেষ্ঠ নেতা ও তরুণ নেতাদের একাংশ এখনই হার্ডলাইনে যাওয়ার পক্ষে। তারা মনে করেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ। তারপরও সরকার তাকে জামিন দিচ্ছেন। মুক্তির মেয়াদ বাড়ালে কার্যত তাকে ফিরোজায় ‘গৃহবন্দি’ অবস্থায় রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে দলের সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শন করার দরকার।

রাজপথে ব্যাপক শোডাউনের নজির সৃষ্টি করতে হবে। কঠোর কর্মসূচি পালন করলে সারাদেশে নেতাকর্মীদের মনোবল আরো চাঙা হবে। ক্ষমতাসীন দল ও বিদেশিদের কাছেও একটি বার্তা পৌঁছে যেত। বর্তমান শান্তিপূর্ণ নরম কর্মসূচি দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্তি এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় সম্ভব নয়। দলের ওপর সারির নেতাদের নমনীয় নীতি তরুণ নেতাদের অনেকেই বাঁকা চোখে দেখছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাইস চেয়ারম্যান নয়া শতাব্দীকে বলেন, আন্দোলনের সঙ্গে এক ধরনের উত্তেজনা ও উদ্বেগ জড়িত থাকে। মানুষ সংঘাত ও সহিংসতা চায় না। রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তন চায়। বিএনপিকে সেই পরিবর্তনের রাজনীতিই দিতে হবে। তার মতে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেও জেল-জুলুম সহ্য করতে হচ্ছে। মামলার সংখ্যা কমছে না। নিখোঁজের তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। তাই শান্তিপূর্ণ আর কঠোর আন্দোলনের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।

বিএনপির দলীয় একটি সূত্র জানায়, বিএনপির লক্ষ্য— কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারে অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। তাদের অধীনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা। তাই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আগামী সংসদ নির্বাচনে তার অংশ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার পক্ষে কট্টরপন্থী ও তরুণ নেতারা।

অন্যথায় আবারো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে ব্যবহার করে একতরফাভাবে নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়ে যাবে। ফলে খালেদা জিয়া ছাড়া সারাদেশের নির্বাচনি মাঠে ভোটারদের কাছে টানার মতো অন্য কোনো কারিশম্যাটিক নেতা বিএনপিতে নেই বলেও মনে করছেন অনেকে। কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এই মুহূর্তে মামলার কারণে দেশে আসতে পারছেন না।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম নয়া শতাব্দীকে বলেন, সরকার পতনের জন্য কঠোর আন্দোলনে যেতে হবে বিএনপিকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে, রেলওয়েতে অবরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, সরকারের বিরুদ্ধে মাঠের নামার সময় হয়েছে।

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল বলেন, বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। এসব প্রস্তুতি অবধারিতভাবেই হোঁচট খাবে যদি আন্দোলনের সামনের সারিতে যোগ্যরা না থাকে। জানা যায়, একাদশ নির্বাচনের পর থেকেই শান্তিপূণ কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি।

কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া জ্বালাও পোড়াও রাজনীতি থেকে সরে এসেছে। ‘ইতিবাচক’ রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে সামনে এগোতে চায় দলের হাইকমান্ড। এরই মধ্যে অনশন, অবস্থান, মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর, বিক্ষোভ সমাবেশ, গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি, কূটনৈতিকদের সঙ্গে বৈঠক, বিভিন্ন পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়সহ বেশ কয়েকটি কর্মসূচি বাস্তবায়নও করেছে দলটি। এরই মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ‘সর্বগ্রাসী দুর্নীতির’ প্রতিবাদে সারাদেশে প্রতীকী অনশন ও স্মারকলিপি প্রদানসহ পাঁচ দিনের কর্মসূচি পালন করবে দলটি।

এর আগে একই দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলসহ ১১ দিনের কর্মসূচি পালন করে দলটি। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার দাবিতে সারাদেশে সমাবেশ করেছে দলটি। তবে ২০২৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে কর্মসূচিতে পরিবর্তন আসবে। এ মুহূর্তে বিএনপির মূল লক্ষ্য খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করা।

পটুয়াখালী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন সহ্য করে তৃণমূল কোনোরকমে বেঁচে আছে। আগে একটু ভীতু থাকত, কর্মসূচিতে খুব একটা বের হতো না। তবে এখন সেই ভয় নেই। তারা এখন বাঁচার মতো বাঁচতে চায়, দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার কারামুক্তি চায়, অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সরকার পতনের আন্দোলনের চায়।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। তাকে ছাড়াই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ব্যাপক ভরাডুবি হয় বিএনপির। তখনো জোরালো আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয় বিএনপি নেতৃত্ব। আন্দোলনে সফলতা না পেলেও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কয়েক বছর ধরেই নানা কর্মসূচি দিচ্ছে বিএনপি।

তবে এসব কর্মসূচির কোনোটাই হালে পানি পায়নি বরং বিএনপি ঘরোয়া আলোসভা-সমাবেশ নিয়ে প্রায়ই কটাক্ষ করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তবে ‘ধীরে চলা নীতি’ থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। চলমান সভা সমাবেশ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকমান্ড।

জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ) রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, নির্যাতন নিপীড়নের মুখে তৃণমূল নেতাকর্মীদের দলীয় কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, তারা এই সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তারা খালেদা জিয়ার বিদেশে সুচিকিৎসা ও সরকার পতনে জোরালো আন্দোলনে যেতে চায়।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ