দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর পর গতকাল মঙ্গলবার ১৪ দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গণভবনে বৈঠকে করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বৈঠকের কারণ কী— এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নানামুখী আলাপ-আলোচনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, মাঠের প্রধান দল বিএনপি কয়েকটি রাজনৈতিক দলসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আর এই আন্দোলন মোকাবিলা করার কৌশল হিসেবে ১৪ দলকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্য একটি সূত্র বলছে, সম্প্রতি বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার চাপে রয়েছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যই ১৪ দলের বৈঠক করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, বিএনপি ধাপে ধাপে আন্দোলন শুরুর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই আন্দোলনের লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথাবার্তা বলেছে। বাম গণতান্ত্রিক জোট আগামী ২৮ মার্চ হরতাল ডেকেছে এবং এই হরতালকে বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সমর্থন জানিয়েছে। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি মেরুকরণ হচ্ছে এবং এই মেরুকরণে আওয়ামী লীগ অনেকটাই একলা ছিল। অবশ্য আওয়ামী লীগের এই একলা চলার সিদ্ধান্তটা ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে। আওয়ামী লীগ ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো একক মন্ত্রিসভা গঠন করে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও জাতীয় পার্টি এবং সাম্যবাদী দলকে মন্ত্রিসভায় রেখেছিল। ২০১৪ সালে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাতীয় পার্টি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এবারের মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগের একক মন্ত্রিসভায়।
কেবল মন্ত্রিসভা থেকেই ১৪ দলকে বাদ দেয়া হয়নি, ১৪ দলের কার্যক্রম একরকম নিশ্চুপ ছিল। মোহাম্মদ নাসিম যত দিন ১৪ দলের সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন তত দিন পর্যন্ত ১৪ দলের কাজকর্ম কিছুটা হলেও ছিল, ১৪ দলের অন্তত কাগজে-কলমে একটা সক্রিয়তা ছিল। কিন্তু মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর আমির হোসেন আমু ১৪ দলের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু তার দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ১৪ দলের কার্যক্রম আর কিছুই এগোয়নি। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ মনে করেন যে, দেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতির কারণেই ১৪ দল সক্রিয় ছিল না। এখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই ১৪ দলকে সক্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আর এই উদ্যোগ গ্রহণকে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র বলছে, শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে টানা প্রায় চার ঘণ্টা বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে ছিল কুশল বিনিময়, ব্যক্তিগত খোঁজ-খবর, অভিনন্দন, উদ্বেগ, কৃতজ্ঞতা, ক্ষোভ, অসন্তোষ— সবকিছুর মিশ্রণ। ছিল পাওয়া-না পাওয়ার প্রসঙ্গও। তবে শেষ পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জোটবদ্ধ হয়ে করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সবাই।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় ১৪ দলীয় নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকটি শুরু হয়। বৈঠক শেষ হয় বিকেল সাড়ে ৩টায়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের হাসানুল হক ইনু, শিরিন আকতার, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় নেতারা।
বৈঠকে উপস্থিত শরিক দলের এক নেতা নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘বৈঠকে খোলামেলাভাবে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে। সেখানে বলা হয়, সরকারের অনেক সেক্টর অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এসব বন্ধ করা জরুরি। সরকারের শরিক দল হিসেবে এসব নেতিবাচক বিষয়ের দায়ভার আমাদের ওপরও বর্তায়। সামনে নির্বাচন। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া এখন জরুরি।’ জোটের আরেক নেতা জানান, ‘দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও সরকারপ্রধানকে জানানো হয়েছে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব বিষয়ে তার নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি এসব নিয়ে আরো জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান।
শরিক দলের অপর এক নেতা বৈঠকে বলেন, ‘আমরা ছোট দল। কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে গেছে। সরকার বা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। জবাবে জোটপ্রধান শেখ হাসিনা সব ধরনের অসুবিধা বিবেচনার আশ্বাস দেন।
জোট নেতাদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতাও জানানো হয়। বিশেষ করে করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেন তারা। পাশাপাশি ভূ-রাজনীতিতে অসাধারণ ভারসাম্য রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বকে অনুকরণীয় বলে উল্লেখ করেন শরিক দলের নেতারা।
বৈঠক প্রসঙ্গে সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আগামী নির্বাচন নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তারিত কথা হয়েছে। সেখানে আমরা বলেছি, অতীতের মতো আগামী নির্বাচনেও আমরা জোটবদ্ধ হয়ে জনগণের কাছে যাব। সরকার গঠনে একসঙ্গে কাজ করব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই ইচ্ছার কথা আমাদের বলেছেন।’ দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘সরকারের দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ আরো জোরালো হবে।’
বৈঠকে জোট নেতারা বলেন, ‘আগামী নির্বাচন ১৪ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ থাকবে। নির্বাচনের আগে অন্য কোনো দল এলে জোটের পরিসর বাড়তে পারে, না এলেও ১৪ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ থেকেই দ্বাদশ নির্বাচনে মাঠে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। শরিক জোটের এক নেতা বলেন, আমরা বলেছি ১৪ দলীয় যে জোট সেটি আদর্শিক জোট। দীর্ঘদিন এই জোট সক্রিয় নেই। জোট থাকলেও কোনো কার্যক্রম নেই। কিছুদিন আগে হেফাজত যে তাণ্ডব চালিয়েছে সেটি প্রতিহত করতে ১৪ দলীয় জোট কোনো ভূমিকা রাখেনি।’
বৈঠকে এক নেতা বলেন, আমরা জোটগতভাবে নির্বাচন করলাম। এরপর বিজয়ী হয়ে আমাদের বিরোধী বানিয়ে দিলেন। দূরে ঠেলে দিলেন। আবার বিরোধী হয়েও ৭২ অনুচ্ছেদের কারণে সঠিকভাবে ভূমিকা রাখতে পারছি না। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, গত নির্বাচনের পর এক প্রেক্ষাপটে আপনাদের বিরোধী দল হিসেবে শক্তিশালী হতে বলেছিলাম। পরবর্তীতে আমাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামীতে বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে।
বৈঠক শেষে যা বললেন নেতারা: বৈঠক শেষে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দল জোটবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। তিনি বলেন, ১৪ দলের সঙ্গে ঐক্য বজায় থাকবে। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করা হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে ১৪ দলের যে ভূমিকা সেটিও অব্যাহত থাকবে। নির্বাচনে আসন বণ্টনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবীণ এ নেতা বলেন, এখনই আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে না। এ জন্য আরো আলোচনা প্রয়োজন। অনেক বিষয়ের ওপর আসন বণ্টন নির্ভর করে। এ আলোচনা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরে হবে। বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তখন কি জোটবদ্ধ নির্বাচন হবে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আমু বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা তারা বলছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী করবে এটা দেখার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেব। বিএনপির দেশব্যাপী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ১৪ দল মাঠে নামবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপির আন্দোলনের বিরুদ্ধে ১৪ দল মাঠে নামবে। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগকে যে নির্দেশ দেবেন। সে অনুযায়ী ১৪ দলকে ঐক্যবদ্ধ করে কাজ শুরু করা হবে। জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন হবে। দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে বলেছেন, নিয়ন্ত্রণে রাখার সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বিএনপি নির্বাচনে না এলে কি জোট থাকবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জোট থাকবে। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন হবে। এটা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ১৪ দলীয় জোটের ঐক্য, বর্তমান পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য সবই আলোচনা হয়েছে। খুবই খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। বহুদিন পরে একটা ভালো আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি সরকারের সঙ্গে ১৪ দলের সম্পর্কে যে প্রশ্নটা আছে, সেটাও আপনার নির্মূল করতে হবে। কারণ সব ব্যাপারে আমরা একমত নই। সব বিষয় আমরা মেনে নিয়েছি ব্যাপারটা এ রকম নয়। সুতরাং যেখানে যেটা আছে, সেখানে কোনো ব্যত্যয় থাকলে, বিষয়টি আলোচনায় আসে। আপনি যে বিভিন্ন সময় জনগণের ভোটের নিশ্চয়তা দাবি করেছিলেন। সেই বিষয়ে কি আজকে আলোচনা করেছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একেবারে স্পষ্টভাবে বলেছি গত ইউপি নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্নগুলো এসেছে, জনগণের ভোটদানের অধিকারের যে প্রশ্নটি এসেছে, এসব ব্যাপারটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
জোট নেত্রী কী বলেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, নেত্রী কী সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন? জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, সরকারি দলের কাছে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়নি। আলোচনাটা হয়েছে ১৪ দলীয় জোট প্রসঙ্গে। আমরা মূলত কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। সেটি ফলপ্রসূ হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো রাষ্ট্রের চিরশত্রু, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী এবং সন্ত্রাসী শক্তি রাষ্ট্রের মূলভিত্তিতে হামলা ও আঘাত করছে। তাই আমরা মনে করি এখনো ১৪ দল রাখার প্রয়োজন রয়েছে। তেল, গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম যেন বৃদ্ধি না করা হয়, সেই বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিএনপি সম্পর্কে বলেছেন, তারা একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ। তাই তিনি চান আওয়ামী লীগের বিকল্প একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হোক। সেটি ১৪ দলভুক্ত, আমাদের রাজনৈতিক মূল ভিত্তি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক এবং স্বাধীনতার পক্ষের চেতনা। সুতরাং সেই শক্তির থেকে আরেকটি বিকল্প শক্তির উত্থান হোক— সেটাই ওনার প্রত্যাশা।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ