ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কী বলছেন রাজনৈতিক নেতারা?

প্রকাশনার সময়: ১৫ মার্চ ২০২২, ১২:০৫

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে বাড়ছে জনরোষ। বিগত দুই বছর ধরে বাজারে সব পণ্যের দামেই অস্বস্তি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আরেক দফা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। বোতলজাত গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। আর এসব অস্বস্তিতে জনগণ এখন ঘর ছেড়ে রাজপথমুখী হচ্ছে। জনমনেও বাড়ছে সরকারবিরোধী ক্ষোভ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিই এখন দেশের রাজনীতিতে প্রধান ইস্যু। তাই সব রাজনৈতিক দল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ করায় ফের সরব হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। জনসম্পৃক্ত এসব বিষয়কে পুঁজি করে সরকারবিরোধী জোরালো আন্দোলনের পথে হাঁটছে সরকারবিরোধী দলগুলো।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তারা সারাদেশেই সভা-সমাবেশ করছে। সঙ্গে যোগ দিচ্ছে তাদের জোট শরিকরা। বাদ যায়নি সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও। বসে নেই বামদল। আগামী ২৮ মার্চ সারাদেশে অর্ধ দিবস হরতাল পালনের ঘোষণা দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। হরতালে বিএনপি সমর্থন দিতে পারে বলেও জানা গেছে। তবে বামজোট এরই মধ্যে তাদের সমর্থন প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইসলামী দলসহ ছোট দলগুলোও তাদের মতো করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ কারণে স্বস্তিতে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। এমনকি সরকারদলীয় জোটের শরিকরাও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অসন্তোষ।

সরকারবিরোধী দলগুলোর নেতারা বলছেন, এ সরকার মানুষের কষ্ট বোঝে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব মানুষ হাহাকার করছেন। অথচ সরকারের লুটপাট আর দুর্নীতির কারণেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। বাজার চড়া হতে হতে এখন জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। রমজানের আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে না আনা হলে রাজপথ ছাড়বে না রাজনৈতিক দলগুলো। যদি সরকার আবারও গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ায় তাহলে রাজপথে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তখন হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবেন তারা।

আর সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী খাদ্য মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করে সরকারকে বিব্রত করতে চায়। তারা বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনীতিকেও উসকে দিচ্ছে। আর বিএনপি এটাকে ইস্যু বানিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। ষড়যন্ত্রে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে সরকার।

জানা যায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন রাজনীতির নতুন ইস্যু। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য কিছুটা দায়ী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। তবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সোচ্চার দেশের সরকারবিরোধী দলগুলো। প্রতিবাদে তারা রাজপথে। উত্তাপ ছড়িয়েছে রাজনীতির মাঠ। এ নিয়েই চলছে রাজনীতির মাঠে কাদা ছোড়াছুড়ি। একপক্ষ অন্য পক্ষের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এটি চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, শান্তিশৃঙ্খলা, সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে কঠোর আন্দোলনের মধ্যে বর্তমান সরকারকে হটানো ছাড়া বিকল্প পথ দেখছেন না তারা। আওয়ামী লীগকে আর ছাড় দিতে রাজি নন তারা। তাই দলে চলছে বড় আন্দোলনের প্রস্তুতি। ক্ষমতাসীনদের পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে রূপ দিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে পাশে চায় নেতারা।

জানতে চাইলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল বলেন, তুষের আগুন এমনভাবে প্রজ্বলিত হচ্ছে যে, মানুষজন এখন রাস্তায় নেমে দল বা নেতার জন্য অপেক্ষা করবে না। এ আগুন প্রজ্বলিত হবে সারাদেশে। সরকার যদি এটা দমাতে না পারে তাহলে সরকারের জন্য সামনে কঠিন দিন আসছে। আর বিএনপিও এটাকে পুঁজি করে সামনে এগোনোর চেষ্টা করবে। বর্তমানের এই জনরোষকে শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে সরকার হটানোর জন্য।

দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মোহাম্মদ শাহজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন, জনগণের কথা বলার জন্য শুধু বিএনপি দায়বদ্ধ, নাগরিক সমাজ কথা বলে না, বিএনপি যতটুকু পারে কথা বলে। আমরা চেষ্টা করছি জনগণকে সম্পৃক্ত করে এই আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃসহ জীবনযাত্রা থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায় সেটা বের করার। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, ভোটের অধিকার, মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি দিতে কঠোর আন্দোলনে যাবে বিএনপি।

কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, একদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে মানুষকে বিপদে ফেলছে। অন্যদিকে, এক শ্রেণির মানুষ কৌশলে মানুষের অর্থ লুট করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় করছে। এ ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়া মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা হচ্ছে না। নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন করতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। আর এ লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কল্যাণ পার্টি নিজেদের শক্তিশালী করছে।

এদিকে, বাম সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মানুষ নিদারুণ অর্থ ও খাদ্য সংকটে আছে। এমন বাস্তবতায় তারা হরতালের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। দল-মত-নির্বিশেষে সবাই এ কর্মসূচিতে অংশ নেবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমাদের (সিপিবি) সারা দেশে এক সপ্তাহের কর্মসূচি চলছে, যা শেষ হবে আগামী ১৬ মার্চ। আগামী ২৮ মার্চ সারাদেশে অর্ধদিবস হরতাল পালন করবে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এ দিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি পালিত হবে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২৮ মার্চের ডাকা হরতালে বিএনপির সমর্থন প্রত্যাখ্যান করে সিপিবির নবনির্বাচিত সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, হরতাল আমরা বামপন্থিরা ডেকেছি। বিএনপির সমর্থন তো আমরা চাইনি। বিএনপির রাজনীতি বিএনপি করুক। বিএনপির কোমরে জোর থাকলে আলাদাভাবে করুক। আমরা হরতালে তাদের সমর্থন চাইনি। তবে বিএনপিদলীয় এখনো সমর্থন দেয়ার কথা জানায়নি।

জানতে চাইলে সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, চাল, তেল, পেঁয়াজসহ ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে দেশের বাজারে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির ফলে টিসিবির পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনে দীর্ঘ হচ্ছে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষের লাইন। নিম্নবিত্তের অবস্থা তো আরো করুন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব মানুষ হাহাকার করছে। তবে এ সরকার বধির, গরিবের হাহাকার সরকারের কানে যায় না। মন্ত্রীরা নানারকম কথা বলে মানুষের দুঃখ কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়ের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকার পতনে বৃহৎ কর্মসূচি ঘোষণা করার হুঁশিয়ারি দেন। সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে তার দল।

অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বাংলাদেশ কঠিন সময় অতিক্রম করছে, যখন দেশে দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সংসার চালাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় যেভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে তাতে মনে হয় দেশের মানুষের প্রতি সরকারের কোনো দরদ নেই। সরকার মানুষের কষ্ট বোঝে না, মানুষের মনের ভাষা বোঝে না।

তিনি বলেন, আমরা মানুষের সব অধিকার সুরক্ষিত করতেই রাজনীতি করছি। আমরা মাঠে আছি, মাঠে থাকব। যদি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, যদি দেশের দুর্নীতি বন্ধ করা না হয়, যদি দেশের টাকা পাচার বন্ধ না হয়, টেন্ডারবাজি, দলবাজি আর চাঁদাবাজি বন্ধ না হয় তাহলে জাতীয় পার্টি আর রাজপথ ছাড়বে না।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের লুটপাট আর দুর্নীতির কারণেই দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। কোথাও সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকারের সিন্ডিকেটগুলো কৃত্রিমভাবে সব পণ্যর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর দুর্নীতির কারণে এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে জিনিসপত্রের দাম প্রতিটি ক্ষেত্রে ২০-২৮ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের চরম দুর্নীতির প্রভাব বাজারে গিয়ে পড়ছে এবং জনগণকে তার মাশুল দিতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা তখনই সম্ভব হবে যখন দেশে গণতান্ত্রিক সরকার হবে। তাই জনগণ আর বসে থাকবে না, গণআন্দোলনে ভেসে যাবে ‘অবৈধ’ শাসকগোষ্ঠী। আগামীতে জনগণের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন বলেন, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী খাদ্য মজুদ করে অস্থিতিশীল করতে চায় আর বিএনপি-জামায়াত এই শ্রেণি ব্যবসায়ীদের উসকে দেয়। এরা সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বহু ধরনের ষড়যন্ত্র করেছে। এখনো কিছু ব্যবসায়ী ষড়যন্ত্রে জড়িত। যারা এই মূল্য বৃদ্ধি করে সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায়। জনগণকে বিক্ষুব্ধ করতে চায়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বাজারে নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি ষড়যন্ত্রে জড়িতদের চিহ্নিত করাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ