দেশে সরকার-পদ্ধতি, নির্বাচন কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতায় দীর্ঘস্থায়ী রূপ দেয়ার লক্ষ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘অনানুষ্ঠানিক’ আলোচনা প্রায় শেষ করে এনেছে বিএনপি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘পতন’ ও ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা’র দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে সরকার বিরোধীদলগুলোর মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা শুরু হওয়ার পর্যায়ে। ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে ‘অনানুষ্ঠানিক আলোচনা’য় অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছে এসব বিষয়। বৃহত্তর ঐক্যে আগ্রহী নেতারা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে রাজনৈতিক প্রাপ্তি না থাকার কারণে সামনের দিনে আগের ত্রুটিগুলো যেন না হয়, সেদিকে বিএনপিকে গভীর মনোযোগ দিতে হবে।
আর বিএনপির নীতি নির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন, সংসদে দুই কক্ষ প্রতিষ্ঠা এবং ‘আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি’ এই পরিসর থেকে বেরিয়ে নতুন ধরনের যৌথ সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে বিএনপি আন্তরিকভাবে আগ্রহী।
সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আচরণে বিএনপিকে বাছাইধর্মী হতে হবে, এমনটি বলেছেন শরিক একটি দলের প্রধান। তিনি বলেন, এখন বিএনপির নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া সামনে নেই, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও লন্ডনে; এই সময়ে কেবল শরিক দল হওয়ার জন্য নতুন কোনোও প্রস্তাবে সায় দেবে না তার দল। এক্ষেত্রে বিএনপিকে নেতৃত্ব ও পরিবর্তনের পরিপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। পরিবর্তন গুণগত না হলে ‘কেবল বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর আন্দোলন করব না’ মাহমুদুর রহমান মান্নার এই বক্তব্যে সহমত প্রকাশ করেন তিনি।
একাধিক দলের নেতারা বলেন, ‘নির্বাচিত হলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন’ গত নির্বাচনে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বিএনপি। ভবিষ্যতে যেন সেই পরিস্থিতি আর না হয়। ‘কালেক্টিভ পদ্ধতি’তে দলীয় নেতৃত্ব দিলেও যুগপৎ কর্মসূচিতে বিএনপির নেতৃত্ব কীভাবে প্রতিফলিত হবে, তা যেন আগেই নিশ্চিত করা হয়। একই সঙ্গে জামায়াত ইস্যুতে পরিষ্কার সিদ্ধান্তে আসার পাশাপাশি নতুন কোনো জোট না করে বরং সবাই মিলে একই দাবিতে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ আগ্রহী নেতাদের।
জোট নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে এমন কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারা জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতির সামনে নতুন রাজনৈতিক অবস্থানের কথা জানাতে চায় বিএনপি। একইসঙ্গে বিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোও ন্যূনতম দাবির ভিত্তিতে স্থায়ী সমাধানে আগ্রহী।
দলীয় সূত্রমতে, ইতোমধ্যে দলের শীর্ষ এক নেতার নির্দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘অনানুষ্ঠানিক’ পর্বের আলোচনা প্রায় শেষ করে এনেছেন বিএনপি। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিতর্কিত কিছু বিষয়ের সমাধান টানার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে মধ্যপন্থার একটি সিদ্ধান্তে আসতে চায় বিএনপি। অনেকে এ পর্ব সমাপ্ত করে পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করার অপেক্ষায় রয়েছেন। কেননা জামায়াতের কারণে অনেক রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে আসতে আগ্রহী নয়। ভোটের রাজনীতি মাথায় রেখেই জামায়াত নিয়ে নয়া হিসাব কষছে বিএনপি। পরে যাতে এ নিয়ে কেউ বেঁকে বসতে না পারে। সে সঙ্গে নানা কারণে মন খারাপ থাকা বিএনপি ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গেও দূরত্ব কমিয়ে আনছে। যাতে ঐক্য হওয়ার পর কেউ কানাঘুষা করতে না পারে। বিএনপি সত্যিকার অর্থে দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়— এমন বাক্যে এক ছায়ায় আনতে চায় সবাইকে।
জানা গেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ইতোমধ্যে আলাদাভাবে কথা বলছেন সরকারবিরোধীদের সঙ্গে। ইতোমধ্যে ২০ দলীয় জোটের তিনটি শরিক দলের প্রধান, বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আলোচনা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নাগরিক ঐক্যর সঙ্গে আলোচনা করেছে বিএনপি। এসব আলোচনায় মোটাদাগে একটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য এসব নেতা ঐক্যবদ্ধ। তবে ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় আন্দোলন হবে, তা নিয়ে এখন চলছে আলোচনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির দুইজন সদস্য বলেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ইতোমধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করছেন নেতারা। তবে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যের অংশ হিসেবে নতুন কিছু প্রস্তাব হাজির করতে চায় বিএনপি। একাধারে ঐক্যে আগ্রহী দলগুলোও এসব বিষয়ে বিএনপির পূর্ণ প্রতিশ্রুতি চায়।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের বিদেশ বিষয়ক উইংয়ের প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, গণতন্ত্রমনা, ভোটাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকারে, মানুষের নিরাপত্তা অধিকারে বিশ্বাস রাখে এবং আইনের শাসনের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে মানুষের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে। আর এখন এই পুরো বিষয়টিকে ‘ফর্মুলাইজড’ করা। তিনি দাবি করেন, এই বিষয়গুলোতে নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। এখন এ বিষয়টিকে ফর্মুলাইজড করে এগিয়ে যাওয়াই সবার লক্ষ্য।
আমীর খসরু বলেন, সকলের প্রত্যাশা, সকল গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রত্যাশা সকলে মিলে, দেশে-বিদেশে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে এমন একটি শক্তি গড়ে তোলা, যেন এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। আমাদের আসতে হবে, সকলের মধ্যে প্রত্যাশা জন্মেছে।
বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কারও কারও মতে, বিএনপির জন্য এককভাবে ক্ষমতায় আরোহণ করা অনেকটা অসম্ভব পর্যায়ে চলে গেছে। দলের নেতৃত্ব দেশে সুষ্ঠু সরকার ব্যবস্থা ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে আগ্রহী। এ কারণেই ডান-বাম ধারার একটি সম্মিলিত ধারার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চায় বিএনপি। তবে বিগত সময়ের মতো এবার ঐক্যবদ্ধ কোনো জোট না করে সমন্বিত দাবিতে ‘যুগপৎ’ কর্মসূচির পক্ষে মত দিচ্ছেন দলের সিনিয়র অনেক নেতা। পাশাপাশি ঐক্যে আগ্রহী দলগুলোও চায়, এক ছাতার তলে না এসে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মতো কর্মসূচি পালন করতে।
জানতে চাইলে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বিত ও যুগপৎ বৃহৎ ঐক্য গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। ভোটাধিকার, সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রসঙ্গে ধারণা করি কোনো দ্বিমত নেই।
তিনি বলেন, কেবল সরকার পরিবর্তন করতে চাই না। আমরা সাংবিধানিক কাঠামো ও ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করা, সামপ্রদায়িক বিদ্বেষী ধারা যেগুলো আছে, তা বাদ দেয়া, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রসঙ্গগুলো গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিএনপিকেও বলেছি, এসব বিষয়ে পরিষ্কার বক্তব্য প্রয়োজন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল অব সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, তার দলের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে গুণগত পরিবর্তন ও নেতৃত্বে অংশগ্রহণ। সেক্ষেত্রে প্রশাসনিক কাঠামো, বিচার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসহ সর্বোপরি নির্বাচনি ও সংসদীয় ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন।
তিনি বলেন, এ ধরনের সংস্কার ও আকাঙ্ক্ষাগুলো যেন আগামী দিনে বাংলাদেশ গঠন এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাফল্যের পর হারিয়ে না যায়, তার নিশ্চয়তা দরকার। জোনায়েদ সাকি নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলনও বিএনপির সঙ্গে ‘অনানুষ্ঠানিক আলোচনায়’ যুক্ত হয়েছে বলে একটি সূত্র দাবি করেছে।
জোনায়েদ সাকি বলেন, তার দল মনে করে অন্তত সাতটি বিষয়ে ন্যূনতম সংস্কার। একটা কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় জরুরি। এগুলোর মধ্যে হল, সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ হতে হবে সাংবিধানিক কমিশনের মাধ্যমে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন, ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার, রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের ক্ষমতার ভারসাম্য, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন ও প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, সমস্ত কালাকানুন বাতিল এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশের সব নাগরিকের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আইনি সুরক্ষা।
এ বিষেয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য বলেন, এখনই সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব ও প্রাদেশিক ব্যবস্থা গঠনের সুযোগ কম। তবে, সংসদে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ প্রতিষ্ঠার করার প্রতিশ্রুতি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০৩০’-এ পরিষ্কার বলা হয়েছে, বিএনপি এ বিষয়ে আন্তরিক।
২০ দলীয় জোটের শরিক একটি দলের প্রধান জানান, ঐক্যের প্রক্রিয়াটি এ বছর নাগাদ শেষ করে আগামী বছরের শুরুতেই কর্মসূচিতে না গেলে পরে ক্ষমতাসীনদের নতুন কৌশলের মুখোমুখি হতে পারে বিএনপি। তবে স্থায়ী কমিটির প্রবীণ ওই বলেন, আমরা খুব দ্রুতই বৃহত্তর ঐক্য করব। তবে এটা তো আলোচনার বিষয়, সবার মতামত শুনছি। আমাদের অনেক জায়গায় ত্রুটি থাকলেও পরিবর্তনের বিষয়ে বিএনপি আন্তরিক।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ