গণতন্ত্রের প্রতি অসামান্য অবদানের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘ডেমোক্রেসি হিরো’ ক্যাটগরিতে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ উপাধি দিয়েছে কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও) নামের একটি সংগঠন। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে সংগঠনটি খালেদা জিয়াকে ওই অ্যাওয়ার্ড দিলেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় গত মঙ্গলবার। স্বাভাবিকভাবে এত দেরিতে প্রকাশ করায় চারদিকে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বাদ যায়নি সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীরা ও দলের নেতারা। তাদের বক্তব্যের পাল্টা জবাবও দিচ্ছেন বিএনপি নেতারা। এমতাবস্থায় দেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন— উপাধি পাওয়ার সাড়ে তিন বছর পর কেন জনসমক্ষে এলো? আর এতদিন কেনইবা আড়ালে রাখল বিএনপি?
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই উপাধি যখন দেয়া হয় তখন ২০১৮ সাল। ওই সময়ে দুই বছর জেলে ছিলেন ম্যাডাম। তারপর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন কয়েকবার। এখন উনি বাসায় এসেছেন। আমরা তাকে এই সম্মাননার কথা জানিয়েছি। একই সঙ্গে আপনাদেরও জানানো হলো।’
তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের প্রতি অসামান্য অবদান এবং তিনি যে এখনো গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য কারাবরণ করছেন, অসুস্থাবস্থায় গৃহবন্দি আছেন। এসব কারণে এই প্রতিষ্ঠানটি দেশনেত্রীকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ অ্যাওয়ার্ড দিয়েছেন।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার সম্মাননা ক্রেস্ট ও সনদে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ৩১ জুলাই খালেদা জিয়াকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ উপাধি পুরস্কার দেয়া হয়। তাতে উল্লেখ আছে, বাংলাদেশে ও বহির্বিশ্বে অনগ্রসর জনগণের জন্য গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শান্তি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদানের জন্য খালেদা জিয়াকে এ পুরস্কার দেয়া হয়।
সূত্রমতে, বিএনপির পক্ষ থেকে ঢাকার কানাডিয়ান হাইকমিশন সিএইচআরআইওকে যে চিঠি দিয়েছিল তার একটি অনুলিপি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। চিঠিতে দেখা যায়, ‘২০২০ সালের ৫ আগস্ট সংগঠনটি ঢাকার কানাডিয়ান হাইকমিশনকে চিঠি দিয়ে খালেদা জিয়াকে পুরস্কৃত করার বিষয়টি জানায়। জবাবে তৎকালীন হাইকমিশনার জানান, তাদের অনুরোধ অনুযায়ী সম্মাননাপত্রটি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে এ মুহূর্তে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। তিন মাস পর ৪ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত তখনকার হাইকমিশনার বেনোইট প্রিফন্টেইন এ জবাব দেন। তাতে গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি কানাডা সরকারের অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করা হয়।
সিএইচআরআইও’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী— অলাভজনক সংগঠন হিসেবে এর যাত্রা শুরু ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। আইন, সমাজকর্ম, সমাজতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান ও মানবাধিকার খাতের পেশাজীবীরা সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন। ওয়েবসাইটে বলা হয়, মানবাধিকার সুরক্ষা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সহায়তা করা সংগঠনটির লক্ষ্য। এর প্রধান দফতর কানাডার অন্টারিওর টরন্টোতে। কানাডার বাইরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এর শাখা আছে।
জানা যায়, প্রায় চার বছর আগে থেকে বিএনপির নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে মাদার অব ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের মাতা বলে সম্বোধন করেন। এর শুরু হয় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর। ওই বছরই মির্জা ফখরুল ইসলাম ১০ মার্চ খুলনা মহানগরে এক সমাবেশে প্রথম খালেদা জিয়াকে মাদার অব ডেমোক্রেসি বলে সম্বোধন করে বলেন, খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য অনেক সংগ্রাম করেছেন, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ জন্য তাকে আজ থেকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ উপাধি দেয়া হলো। তখন থেকেই খালেদা জিয়াকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বলে সম্বোধন করে আসছে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
২০১৮ সালে এ উপাধি দেয়া হলেও বিএনপি কেন এতদিন পর প্রকাশ করল জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান বলেন, ‘এটা জনসমক্ষে আনতে কেন দেরি হয়েছে তা আমরা বলতে পারব না।’
খালেদা জিয়ার পদক নাকি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের নেতারা চরম আত্মপীড়ন ও মনঃকষ্টে ভুগছেন। তাদের বক্তব্যেই প্রমাণ করে- অতীতে তারা পদক কিনেছেন। কিনে পদক পাওয়ার সংস্কৃতি তো আওয়ামী লীগ নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর। পদক কিনে বস্তা ভরার ইতিহাস তো তাদেরই।’
এত দিন পর এ পুরস্কারপ্রাপ্তি কেন প্রকাশ করা হলো জানতে চাইলে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমরা তো পাবলিসিটি করার পার্টি না। অনেকে হাউস অব কমন্সের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে প্রচার করে, হাউস অব কমন্সে মিটিং করেছি। আমাদের এ অভ্যাস নেই। করোনা পরিস্থিতি, ম্যাডামের অসুস্থতা, নানা কারণে হয়তো এতদিন জানানো হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘খালেদা জিয়ার ট্র্যাক রেকর্ড আছে গণতন্ত্রের জন্য। অনেকে আছেন ট্র্যাক রেকর্ড নেই, তবু নানা পুরস্কার পান। বেগম জিয়া এখনো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য নিজের জীবন দিয়ে লড়াই করছেন। তিনি যে সম্মাননা পেয়েছেন, এটা তার অবদানের তুলনায় কিছুই না।’
জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া কারাবন্দি ছিলেন। গত বছরের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়া সরকারের নির্বাহী আদেশে প্রথমে ছয় মাসের জন্য শর্ত-সাপেক্ষে মুক্তি পান। পরে আরো তিন দফায় মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপর থেকে তিনি গুলশানের বাসায় আছেন।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ