২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে খুব শিগগিরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে বিএনপি। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আলোচনার এজেন্ডা প্রায় গুছিয়ে এনেছেন। চলতি মাসেই শুরু হতে পারে এই বৃহত্তর জোট গঠনের আলোচনা। সরকারবিরোধী বাম, ডান ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য মতবিনিময়ে দলীয় প্রতিশ্রুতি তুলে ধরবে বিএনপি। এছাড়া অতীতের বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে সম্ভাব্য প্রশ্নের জবাবও ইতোমধ্যে তৈরি করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। সরকারবিরোধী দলীয় ঐক্যের প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে বৃহত্তর জোটে জামায়াত ইসলামী ঘিরে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। জোটে আগ্রহী কোনো কোনো দল বলছে, জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান জানার পরই বৃহত্তর জোটের নতুন উদ্যোগটি সামনের দিকে এগোবে। নয়া শতাব্দীর সঙ্গে আলাপকালে বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, সরকারের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক দল তৎপর, তাদের সবার সঙ্গেই কথা বলতে পারে বিএনপি। তবে জামায়াত ইস্যুতে তাদের অবস্থান আগেই পরিষ্কার হতে হবে। বিএনপি আসলে কী করতে চায়, সেটাও দলীয়ভাবে তুলে ধরতে হবে।
জানতে চাইলে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমাদের সঙ্গে আলোচনায় এলে বিএনপির কাছে আমরা সর্বপ্রথম জামায়াত ইস্যুটি জানতে চাইব। তারা কী বলে সেটা শুনব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা তো ইসলামপন্থিদের সঙ্গেও কথা বলতে পারে। এই সরকারের বিরুদ্ধে যারাই সোচ্চার রয়েছে, তাদের সঙ্গেই তারা বলতে পারে। যারা যারা এই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায়, তাদের সবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আছে। আলোচনা করতে কোনো সমস্যা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এক প্রভাবশালী নেতা নয়া শতাব্দীকে বলেন, ২০ দলীয় জোট বা ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে দেবে বিএনপি, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং এই জোটগুলোর সঙ্গে আরো বাড়ানো যায় কিনা, সে চেষ্টা করবে সম্ভবত। তবে এসব চিন্তা ইউটোপিয়ান চিন্তা। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে চিন্তা করতে হবে।
তবে আরেক বাম দল বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান মনে করেন, জনগণের সামনে যার যার অবস্থান পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হবে, গুণগত পরিবর্তনের জন্য কোন দল কী করতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন ও সংবিধানের মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে জনগণের জন্য কার কী করার আছে, সেটা আগে পরিষ্কার করতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণের নেই। বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা, আমলাতন্ত্র, নির্বাচন প্রক্রিয়া এসব বিষয়ে মৌলিক পরিবর্তন কীভাবে আসবে, তা ঠিক করতে হবে। ফলে শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা থাকলেও জনগণের দুর্ভোগ কমাতে কারা কী করতে চায়, সেটাই এখানে বিবেচ্য।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম একজন উদ্যোক্তা দাবি করেন, জামায়াত ইস্যুটি বড় না করে বিষয়টিকে কৌশলগত জায়গা থেকে বিবেচনা করার জন্য। বিশেষ করে জোট ভেঙে দিলে বা বের করে দিলে সরকারি দল জামায়াতকে কাজে লাগাবে, এমন সন্দেহও প্রকাশ করেন তিনি। ওই নেতা আরো বলেন, জামায়াতের যেহেতু ধর্মভিত্তিক ঘরানার সমর্থন রয়েছে, সে কারণে দলটিকে আরো কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাখা যায় কিনা, সে বিষয়টিও আমলে নিতে পারে বিএনপি।
জামায়াত ইস্যুতে বিএনপিকে পরামর্শ দিয়ে ২০ দলীয় এক নেতা বলেন, জামায়াত ইস্যু তাদের কাছে পরামর্শ দিয়েছি, যদি চলতে না চান, তাহলে তাদের সঙ্গে বসে আলাপ করে বোঝান, যে; এতে করে আন্দোলনের ক্ষতি হচ্ছে, নিজেদের লাভ হচ্ছে না।
এদিকে, খোদ বিএনপিতে জামায়াত-প্রশ্নে দুই ধরনের অবস্থান। দলের স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য মনে করেন, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে জামায়াতকে পাশে রেখে কোনোভাবেই কার্যকর কোনো রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করতে পারবে না বিএনপি। আর স্থায়ী কমিটির দুই-তিনজন মনে করেন, ক্ষমতাসীন সরকারের পতন নাকি জামায়াত— কোনটি বড় সমস্যা তা বিএনপিকে ঠিক করতে হবে।
আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী দুই সদস্য বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ স্থায়ী কমিটির অন্তত অধিকাংশ সদস্য জামায়াতকে বাদ রেখে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের পক্ষে। ইতোমধ্যে দলের অভ্যন্তরে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে জামায়াতকে ছেড়ে দেয়ার। আর এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেই দলটির সঙ্গে যৌথ কোনো কর্মসূচি পালন করেনি বিএনপি। তবে জামায়াতকে কোন কৌশলে বাদ দেয়া হবে, তা চূড়ান্ত করতে পারেননি দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব।
তারা বলেন, এই বিএনপি বিগত ২০ বছর আগের বিএনপি নয়। দলের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন এসেছে কিনা তা সামনে আসবে জামায়াত ইস্যুটি নিষ্পত্তি করার ওপর। সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে বিএনপির গুণগত পরিবর্তনের পলিসি কী হবে, তা নির্ভর করবে এই সিদ্ধান্তের ওপর।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, দেশের সামনে সরকার সমস্যা নাকি জামায়াত সমস্যা। এটাও তো বিবেচনায় নিতে হবে। এরপর আছে আমরা কি এজেন্ডা রাখব ঐক্যের জন্য? এজেন্ডা দেখে রাজনৈতিক দলগুলো মতামত দেবে। হয়তো কোনোটা যুক্ত হবে, কোনোটা বাদ পড়বে।
যদি দাবি আদায় করতে হয়, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটাধিকার অর্জন করতে হয়, তাহলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু নয়া শতাব্দীকে বলেন, জামায়াত ইস্যুতে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা পরিস্থিতি বাতলে দেবে। সব সময় একই রণনীতি ফলো করা হয় না।
জানা যায়, গতকাল সোমবার রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও জামায়াত ও বৃহত্তর জোট বিষয়েও আলোচনা হয়। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে চলতি মাসেই। তবে বৃহত্তর জোটে জামায়াত থাকবে কিনা এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিএনপি। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময় জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট অক্ষুণ্ন রেখেছিল বিএনপি।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ