জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের ব্যর্থতার পর অনেক দিন ধরেই সরকারবিরোধী একটি বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও প্রায় চলে এসেছে। বাকি আছে দুই বছরের কম। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন করতে চায় বিএনপি। প্রয়োজনে বিএনপি তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টে পরিবর্তন আনতে পারে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব ‘নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই ‘এক দফা’ দাবিতে আন্দোলনে নামার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছে এ তথ্য।
স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, বর্তমান করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি কার্যক্রম গুছিয়ে রাখতে চায় বিএনপি। এর অংশ হিসেবে বৃহত্তর জোট গঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে সেই বৃহত্তর জোটে রাখা না রাখা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অভিন্ন দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের উদ্দেশ্যে এ ঐক্য গড়তে চান তারা।
তারা বলছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার দাবিতে অনুষ্ঠিত নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে নেতাকর্মীদের ব্যাপক চাঙাভাব তৈরি হয়েছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতেও তারা ভয় পায়নি। এ চাঙাভাবটা ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি বিশেষ করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলন সফল করতে বৃহত্তর জোট গঠন প্রক্রিয়া পুরোদমে চালিয়ে যেতে হবে।
দলীয় সূত্রমতে, গত শুক্রবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল মাধ্যমে রাত ৯টা শুরু হয় বৈঠক। প্রায় ৫ ঘণ্টা ওই সভা চলে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নির্বাচন কমিশন গঠনে বিল পাস হয়। এর পরদিনই বিএনপি ওই সভা করে। এতে দেশের সমমনা ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়। করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণে মাঠের রাজনীতিতে পরিবর্তে ঘরোয়া ও ভার্চুয়াল সভা-সংলাপের ওপর জোর দিয়েছে দল। সভায় বৃহত্তর জোট গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনসহ সামগ্রিক রাজনৈতিক ইস্যুতে শিগগিরই বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে বিএনপি। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে বা শেষের দিকে এই আলোচনা শুরু হতে পারে।
জানা যায়, বিএনপি ২০ দলীয় ঐক্য জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের দুইটি জোট আছে। সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে গণফোরাম, জেএসডি, কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্য নিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করে বিএনপি। তবে ঐক্য গড়লেও নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে তাদের। ওই নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত ফলাফলের পর থেকেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট দুইটিই এখন কার্যত নিষ্ক্রিয়। এমতাবস্থায় নতুন করে বৃহত্তর জোট গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
জানা গেছে, বিএনপির ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতকে নিয়ে দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আপত্তির কথা বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছে। প্রতিবেশী ভারতসহ ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোও জামায়াত বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এ অবস্থায় দলের স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ ভার্চুয়াল বৈঠকেও জাতীয় বৃহৎ ঐক্য গঠন ও জামায়াতের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। তবে জামায়াত নিয়ে শুক্রবারের বৈঠকে পরিষ্কার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির দুইজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত জোটের সঙ্গে যুক্ত থাকায় দেশি-বিদেশি অনেকেই বিএনপির সমালোচনা করে আসছে। এ কারণে জোটগতভাবে ‘শক্তিশালী’ আন্দোলন করেও আন্তর্জাতিক ও দেশীয় শক্তির সমর্থন না পাওয়া এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে অনেকের দাবি ও মতের মিল হলেও জামায়াত থাকায় কয়েকটি দল তাদের সঙ্গে ঐক্যে আসছে না।
তারা বলেন, জামায়াতের বর্তমান কর্মকাণ্ডে বিএনপিতে নানা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাদের কাছে এমনও খবর রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে জামায়াত এককভাবে তিনশ আসনে প্রার্থী দেবে। এ অবস্থায় জামায়াতের একটি অংশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করছে। গুঞ্জন রয়েছে, সব ঠিক থাকলে জামায়াত তার নিবন্ধনও ফিরে পেতে পারে। এ অবস্থায় জামায়াত বিষয়ে কোনো গুঞ্জনই উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বৃহত্তর জোট গঠনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চলছিল। তবে তা হচ্ছিল না। তবে সরকার নিজেদের পছন্দমতো ইসি গঠনে বিল করে আবারো একতরফা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। বিল পাসের পর তারা তাগিদ অনুভব করেন যে এই সরকারকে আর বেশি দিন সময় দেয়া যায় না। এক দফা নিয়ে আন্দোলনে নামা ছাড়া সামনে বিকল্প নেই।
বিএনপির দুই জোটকে সঙ্গে রেখে কোন ফর্মে বৃহত্তর জোট হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি বলে জানান বিএনপির আরেক নেতা। ওই নেতার ভাষ্য, তবে এ বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আর যে যেখানে আছেন, তাদের সবার সঙ্গে এক দফা নিয়ে আলোচনা করেই বৃহত্তর জোট গঠন করা হবে। কাউকে বাদ দেয়া হবে না। যে যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখবেন এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ভবিষ্যতের প্রশ্নে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দলীয় অবস্থান তুলে ধরতে এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ইস্যুতে তাদের মনোভাব জানতে চায় বিএনপি। ফেব্রুয়ারি মাসে মতবিনিময়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। মতবিনিময়ের জন্য সুনির্দিষ্ট দলগুলোর সঙ্গে প্রাক-আলোচনা করেই বিএনপির প্রতিনিধি দল যাবে। সরকারবিরোধী সব দলকে প্রাধান্য দেয়া হবে। রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি, সেসব দলকে ধন্যবাদ জানাবে বিএনপি। সরকারবিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্যদের পৃথকভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বিএনপির প্রভাবশালী গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা বলেন, রাজনৈতিকভাবে গুণগত পরিবর্তনের বিষয়টিকে বিএনপিকে কীভাবে দেখছে সেই বিষয়ে নজর থাকবে মতবিনিময়ে সম্মত দলগুলোর। অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতার ভারসাম্য, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণসহ মৌলিক কিছু বিষয়ে বিএনপির ‘প্রতিশ্রুতি’ জানতে চাইতে পারেন রাজনৈতিক নেতারা। সেক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান কী হবে তার ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী রাজনৈতিক ঐক্য।
তবে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রশ্নে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রদত্ত ভিশন-২০৩০-তে স্পষ্ট করেই বিএনপির অবস্থান বর্ণিত হয়েছে। দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিএনপি আন্তরিক।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘গতকালের (শুক্রবার) সভায় কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে রাজপথে যারাই থাকবে, তাদের নিয়েই আমরা বৃহত্তর জোট গঠনের চিন্তা করছি।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এটা আমরা দ্রুতই শুরু করব। এখনো সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করিনি। মতবিনিময়গুলো আমরা জনসম্মুখে জানিয়েই করব। আশা করি, করোনার বিধি-নিষেধের সময়টাতেই ঐক্যপ্রক্রিয়ার কাজ শেষ করতে পারব।’
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ