শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে বিএনপি। কেন্দ্রীয়, মহানগর, জেলা-উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত নানা পর্যায়ে চলছে এ শুদ্ধি অভিযান। এই অভিযানের মূল মাপকাঠি- বিগত বছরে সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচিতে ভূমিকা, দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে ভূমিকা। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করায় কাউকে দেয়া হচ্ছে অব্যাহতি, শৃঙ্খলা ভঙের দায়ে কেউ হচ্ছেন বহিষ্কার। আবার কমিটি গঠনের অজুহাতেও বাদ পড়ছেন অনেকে। এভাবেই নানা অজুহাতে একের পর এক ডাকসাইটে নেতাকে দলীয় দায়িত্ব ও পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই তালিকা আরো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কায় নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে দিয়ে বিএনপিতে যেমন আসবে নতুন মুখ, তেমনি অনেকে হারাবেন পদ। এ নিয়ে দলের ভেতরে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। আতঙ্কে রয়েছেন অনেকেই। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, অব্যাহতি ও বহিষ্কার দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। সুনির্দিষ্ট কারণেই কেন্দ্র থেকে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সিদ্ধান্ত অমান্য করলে দলের স্বার্থে শাস্তি অপরিহার্য। এখানে কে কত বড় নেতা— তা দেখার বিষয় নয়। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এসব পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই।
দলে এ শুদ্ধি অভিযানের পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতাদের যুক্তি—যুগের পর যুগ একই ব্যক্তি একই পদে থাকবেন, একই ব্যক্তি বড় বড় পদে থাকবেন; আর সারা জীবন মন্ত্রী-এমপি হবেন তা হতে পারে না। তা ছাড়া ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তি যেভাবে কাজ করতে পারবেন, ৬৫ বছর বয়সীর পক্ষে তা সম্ভব নয়। নতুন নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রেও অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কার্যত দল চালাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেশের বাইরে থেকেই তিনি সব সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন; সিনিয়র নেতারা শুধু তা বাস্তবায়ন করছেন। দলটিতে খালেদা জিয়ার একনিষ্ঠ নেতারা অনেকটাই কোণঠাসা ও বাকরুদ্ধ। দলের সিনিয়র ও পুরনো নেতাদের অনেককে তারেক রহমান পছন্দ করেন না। এ কারণেই বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ চাপা কোন্দল প্রকাশ হচ্ছে।
তারা বলেন, সম্প্রতি দল থেকে ডাকসাইটের কিছু নেতাকে বহিষ্কার ও অব্যাহতির কারণে দলের অভ্যন্তরেও তৈরি হয়েছে থমথমে পরিস্থিতি। অনেকেই বুঝতে পারছেন না, দলের কঠিন সময়ে এমন নেতাদের বাদ দিয়ে কিভাবে সুসংহত হবে। কারণ সেখানেও তার একটা নিজস্ব বলয় ও সমর্থক গোষ্ঠী বিদ্যমান। যা আগামী দিনে আন্দোলন সংগ্রামে প্রভাব ফেলতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু নয়া শতাব্দীকে বলেন, বিএনপিতে জিয়াউর রহমানের পরিবারই শুধু অপরিহার্য। বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এর বাইরে আমরা যে যত বড় নেতাই হই না কেন কেউই অপরিহার্য নই। দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজেকে জাহির করাটাই সাংগঠনিক অপরাধ। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে দলের স্বার্থে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি অপরিহার্য।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘দলের হাইকমান্ড যা কিছু করছেন সবই দলের স্বার্থে। তিনি উপলব্ধি করছেন এখন তরুণদের সামনে আনা দরকার, সেজন্য এমনটি করা হচ্ছে। বড় দল হিসেবে বিএনপিতে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবেই। তবে দলের প্রধানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ৩০ বছর বয়সে আমি যেসব কাজ করেছি তা এখন আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।’
দলের নীতি-নির্ধারক মহলের সদস্যরা এ উদ্যোগকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিলেও নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার, পদ থেকে অব্যাহতি ও স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘটনা এসব নিয়ে দলের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে কমিটি পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের দল থেকে বাদ দেয়ায় তৃণমূলে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। এতে আগামী দিনে রাজপথের আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এ বহিষ্কার ও অব্যাহতির পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। দলীয় হাইকমান্ডকে ভুল বুঝিয়ে দলের একটি অংশ এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে কাজ করছে বলে অভিযোগ তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুরুত্বপূর্ণ দু’জন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপির বিভিন্ন জেলা ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের পুনর্গঠন চলছে। আগামী কাউন্সিল অধিবেশনের আলোচনা হচ্ছে। তার আগে কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যন্ত কমিটিগুলোর কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, তা-ই শুরু হয়েছে। কেউ কেউ পদোন্নতি পাবে। আবার কেউ কেউ শাস্তির মুখেও পড়বেন। নতুন কমিটিগুলো হবে সামনের আন্দোলন-সংগ্রামকে সফল করার লক্ষ্য। ফলে আসন্ন কমিটিগুলোতে অধিক প্রাধান্য দেয়া হবে অপেক্ষাকৃত তরুণ, সাহসী নতুন মুখ। যারা রাজপথের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। তাই যাদের দিয়ে আন্দোলন হবে না, স্বাভাবিক কারণে তাদের দায়িত্বও দেয়া হবে না।
জানা যায়, বরিশাল জেলা ও মহানগরের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের নেতৃত্ব—মজিবর রহমান সরোয়ারকে হঠাৎ বাদ দেয়ায় সেখানকার নেতা-কর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। একই অবস্থা রাজশাহীতেও। মহানগরী বিএনপি থেকে হঠাৎ সরিয়ে দেয়া হয় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকেও। কুমিল্লার মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকেও কেন্দ্রীয় পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। দলের সিদ্ধান্ত না মানায় প্রথমে শোকজ ও পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় খুলনায় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে। এতে নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ করেন। পরে খুলনা জেলা ও মহানগরী বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৫ শতাধিক নেতা একযোগে দল থেকে পদত্যাগ করেন। ডাকসাইটে এসব নেতাদের বহিষ্কারের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে সবশেষ নারায়ণগঞ্জের ভোটের পর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা আহবায়ক স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার ও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালকে বহিষ্কার করে দলটি। দুজনকে বহিষ্কার নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয় নেতাদের মতে, তৈমূরের মতো নেতা এক দিনে সৃষ্টি হন না। দীর্ঘদিন রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছেন তিনি। হঠাৎ এমন একজন পরীক্ষিত নেতাকে বহিষ্কার করা উচিত হয় নি। তৈমূর আলম খন্দকারের মতো পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের বহিষ্কারে তৃণমূলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না তা সময়ই বলে দেবে। এ ছাড়া সমপ্রতি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়ায় পাঁচ নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারা হলেন— নোয়াখালী পৌরসভা বিএনপি সভাপতি ও জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ আবু নাছের, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম কিরণ, নাটোর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক শেখ এমদাদুল হক মামুন (এমদাদ), নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুল ইসলাম লেলিন (ভিপি লেলিন) ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আমিরুল ইসলাম জামালকেও তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
খুলনার নেতারা বলেন, বিএনপির কঠিন সময়ে মঞ্জুর মতো সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক নেতার অব্যাহতিতে দেশের তৃণমূলে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছেছে। এতে বিএনপিরই ক্ষতি হবে। তৈমূর ও মঞ্জুকে অব্যাহতিতে দলের ভেতরে একটি নেতিবাচক প্রভাব তো পড়তেই পারে। তা তো খুলনায় দেখা যাচ্ছে। তবে সবারই নিয়ম মানা উচিত।
জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, যে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দলকে আরো দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইস্যুতে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে বিভ্রান্তি ছিল। দলের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেকে নির্বাচন করেছেন। কেউ কেউ চেয়ারম্যানও হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেয়নি।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যত নীরব থাকবেন, যত দেরি হবে ততই সংগঠনের ক্ষতি হবে। নীরবতা না ভাঙলে বিএনপির ক্ষতি হবে। খুলনা মহানগরী আন্দোলন- সংগ্রামের হেডকোয়ার্টার। খুলনা বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এখানে বিএনপি সংকটের মধ্যে থাকবে এটা জনগণও আশা করে না। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘দল একটা নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। কেউ যদি শৃঙ্খলা না মানেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ কাজ করলে তাকে তো দলের আদর্শিক নেতা বলা যায় না।’
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ