ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ

‘সংলাপ আনুষ্ঠানিকতা সমাধান আসবে না’

প্রকাশনার সময়: ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:১১

কাল ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সংলাপ। সংলাপ শেষ হওয়ার পর গঠন করা হবে ‘সার্চ কমিটি’। নতুন ইসি গঠনের জন্য এই কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করবেন। রাষ্ট্রপতি সেই প্রস্তাব থেকে বেছে আগামী ৫ বছরের জন্য নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। আর নতুন এই কমিশনের অধীনেই ২০২৩ সালের শেষে হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

সার্চ কমিটির পরিবর্তে ইসি গঠনে আইন করা দরকার বলে মনে করছেন বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। সংলাপে অংশ নেয়া প্রায় প্রতিটি দলই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার প্রস্তাব রেখেছে। আবার কেউ কেউ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রসঙ্গও তুলেছে। দলগুলো বলেছে, সরকার আন্তরিক হলে এক দিনের মধ্যেই আইন করা সম্ভব। নিরপেক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে দলগুলো। রাজনৈতিক দলের নেতারা আলাপকালে নয়া শতাব্দীকে বলেন, স্বাধীনতার পর ৫০ বছরেও কোনো সরকার এ সংক্রান্ত আইন করেনি। কোনো সময় উদ্যোগও নেয়নি। ফলে প্রতিবারই ইসি গঠন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মতভেদ তৈরি হয়। শুধু নির্বাচন কমিশন গঠন নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কোনো নিশ্চয়তা বা সমাধান নয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সংলাপের ফল শূন্য; লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বস্তুত এ সংলাপ শুধু নিষ্ফলই নয়, অতীতে এ সংলাপ থেকে বিষফল সৃষ্টি হয়েছিল। নিষ্ফল প্রক্রিয়ার বিষফল আমরা পেয়েছিলাম রকিবউদ্দীন কমিশন ও নূরুল হুদা কমিশন। যারা আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। এ সংলাপ মূলত লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা। এতে কোনো সমাধান আসবে না।’ সূত্রমতে, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির চলমান সংলাপে ৩২টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্যে বিএনপি ছাড়াও সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সাতটি দল। গত ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে সংলাপ শুরু করেন রাষ্ট্রপতি। যা শেষ হবে ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। সেদিন বিকাল ৪টায় আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি সংলাপে অংশ নেবেন। এখন পর্যন্ত ২৩টি রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নিয়ে তাদের প্রস্তাব তুলে ধরেছে। সংলাপের ডাক পেয়েও অংশ না নেয়া দলগুলো হচ্ছে—বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), এলডিপি ও জেএসডি। বর্জনকারী দলগুলো বলছে, ২০১২ ও ২০১৬ সালেও ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ হয়েছিল। ওই দুই সংলাপে অংশ নিয়ে তারা যেসব প্রস্তাব দিয়েছিল এর কোনোটাই মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে নতুন করে বলার কিছু নেই।

রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন বলেন, ১৭ জানুয়ারিই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনা শেষ হবে। এরপর সার্চ কমিটি গঠন করে দেয়া হবে। রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায় মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে, সেখান থেকেই ঘোষণা দেয়া হবে।

জানা যায়, সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন হবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে। এ বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেবেন। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ২০১২ সাল থেকে রাষ্ট্রপতি সংলাপের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে আসছেন। আগের দুই বারের মত এবারো সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের উদ্যোগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি সংলাপ শুরু করেছেন গত ২০ ডিসেম্বর। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। এ সময়ের মধ্যেই পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটি মনে করে, এখন যে সময় আছে এর মধ্যেই ইসি গঠনের আইন করা সম্ভব। আর তা সম্ভব না হলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করে তা করতে পারেন। একেবারেই আইন প্রণয়ন করা সম্ভব না হলে গত দু’বারের মতো সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেয় দলটি। এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় যোগ্য চার-পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করেছে দলটি।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। তবে আজো সে আইন প্রণয়ন করা হয়নি। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদে তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে রাজি আছেন।’ রাষ্ট্রপতিও তাদের প্রস্তাব শুনে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন বলেও জানান।

সংলাপের দ্বিতীয় দিন অংশ নেয় ১৪ দলের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। সংলাপ শেষে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় আমরা সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা সার্চ কমিটিতে একজন নারী ও একজন অধ্যাপককে রাখার প্রস্তাব দিয়েছি। তবে কোনো নাম প্রস্তাব করিনি।’ আইন করে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। সাত দফা লিখিত প্রস্তাব তুলে ধরে দলটি বলেছে, দেশের মানুষ সহিংস নির্বাচনের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণভাবে সব ধরনের প্রভাবমুক্ত পরিবেশে নির্বাচন দেখতে চায়।

২৭ ডিসেম্বর সংলাপ করে তরিকত ফেডারেশন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে চার দফা প্রস্তাব দেয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সুশীল সমাজকেও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে দলটি। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, আমরা পাঁচ দফা প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেছি। এর মধ্যে আইন প্রণয়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে আইন চায় গণতন্ত্রী পার্টি। আইন করা সম্ভব না হলে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে নিয়ে একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।

গত ২৮ ডিসেম্বর সংলাপ করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত আইন তৈরির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে দলটি। আইন করার মতো সময় নেই- আইনমন্ত্রীর এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান, সে আইনটি কিন্তু এক রাতেই হয়েছিল, যেটা নিয়ে পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। এমনকি যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রশ্নে সংবিধান সংশোধনেও আমাদের বেশি সময় লাগেনি। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীও দু-এক দিনেই করা হয়। তাই আমরা রাষ্ট্রপতিকে বলেছি ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শীতকালীন অধিবেশন বসবে। এ অধিবেশনেই ইসি গঠনে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ মতে আইন তৈরি করে তা পাস করা সম্ভব।’ মেনন জানান, অন্যথায় প্রতিবারের মতো এবারো নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক জন্ম দেবে এবং এ ধরনের আস্থাহীনতার পরিবেশে নির্বাচন কমিশন যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারবে না। আইন প্রণয়ন একান্তই সম্ভব না হলে বিকল্প হিসেবে সার্চ কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

২৯ ডিসেম্বর সংলাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ)। দলের প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম আজাদ বলেন, রাষ্ট্রপতি বিদ্যমান পদ্ধতি অনুসরণ করে সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে ইমানদার ব্যক্তিদের সার্চ কমিটিতে রাখাসহ চারটি প্রস্তাব দিয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে দাবি জানিয়েছেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি মোকাব্বির খান। একই সঙ্গে সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রণয়নে সংসদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান এবং প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানান তারা।

৪ জানুয়ারি সংলাপে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে সাম্যবাদী দল। দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপতিকে বলেছি বর্তমান বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শাসনতন্ত্র মোতাবেক নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা বাস্তবসম্মত। সেই সরকার সংবিধান অনুসারেই গঠিত হবে।’

সংলাপে অংশ নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট। ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এম এ মতিন সাংবাদিকদের বলেন, সংলাপে বিশিষ্ট পাঁচ ব্যক্তির সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংলাপে যোগ দিয়ে সব দলকে নিয়ে নির্বাচনকালীন ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে গণফ্রন্ট। নির্বাচন কমিশন গঠনে পাঁচ সদস্যের নামও তারা প্রস্তাব করেছে। গণফ্রন্টের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে।

সংলাপে অংশ নিয়ে আইন প্রণয়নসহ ছয়টি প্রস্তাব দেয় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। জানতে চাইলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেন, ‘আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে বলেছি, নির্বাচন কমিশন হওয়ার জন্য একটা আইন হওয়া দরকার। এতকিছু হয়, আইন হয় না কেন? সার্চ কমিটি গঠন না করে, সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নিজের উদ্যোগে নির্বাচন কমিশন গঠন করুন। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষকে নিয়ে কমিশন করুন। ’

তিনি বলেন, ‘তিনদিনের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করার প্রয়োজন আমরা মনে করছি না। আর সার্চ কমিটির মাধ্যমে বর্তমান নির্বাচন কমিশন খুব ভালো ফল দেয়নি। আমরা মেরুদণ্ড সম্পন্ন নির্বাচন কমিশন আশা করি।’

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ