রাজনৈতিক প্রতিকূলতায় দীর্ঘ ১৫ বছর বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। জাতীয় সংসদে থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সবখানেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাপটের সামনে অনেকটাই অসহায় দলটি।
সাংগঠনিকভাবেও ক্রমেই পরিণত হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে। যদিও তিন বার সরকারে থাকা এই দলটির রাজপথ কাঁপানোরও নজির রয়েছে একাধিবার। অতীতের সেই সোনালি স্মৃতি থেকেই কঠিন দুঃসময়ে অনুপ্রেরণা খুঁজতে মরিয়া বিএনপি। সে জন্যই রাজনীতির মাঠে রণকৌশলও বদলাচ্ছে বারবার।
বিগত সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার ভেবেচিন্তে ‘হিসাব কষে’ পা ফেলার নীতি গ্রহণ করেছে শীর্ষ নেতৃত্ব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘ভয় ও শঙ্কা’ কাটিয়ে দলকে সক্রিয় করে চূড়ান্ত আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চায় দল। বিশেষত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে অনেকটা অঘোষিত ‘এক দফা’ নিয়েই মাঠে নেমেছে নেতাকর্মীরা। সঙ্গে সরকার পতনের আন্দোলন ইস্যু তো রয়েছেই।
চলমান আন্দোলন থেকে পাওয়া রসদ নিয়ে বিএনপি চলতি বছরেই বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়। আন্দোলন আরো সুসংগঠিত ও বেগমান করতে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে চলছে তোড়জোড়। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক এগোচ্ছে। তবে অতীতে বিভিন্ন সময়ে কঠোর কর্মসূচিতে ব্যর্থতার কারণে নতুন করে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া বা কর্মসূচিতে যেতে চাইছে না বিএনপির হাইকমান্ড। দলীয় সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র- এ দুটিকে ভিত্তি ধরেই তারা এগোচ্ছেন এবং দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিও পালন করছেন। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ জেলায় সভা-সমাবেশ করেছে দলের নেতাকর্মীরা। এবারের কর্মসূচিও অনেকটা কার্যকর। এর মাধ্যমে জনমত তৈরি, আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত ও দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা যাচাই করবে দলটি।
তাদের বিশ্বাস, খুব শিগগির পাওয়া যাবে চলমান আন্দোলনের সফলতা। দ্রুত আন্দোলনের নতুন কৌশল প্রয়োগ করা হবে। তবে অভিনব সেই কৌশল এখনো রহস্যের সিন্দুকেই বন্দি। এমনও বলা হচ্ছে— নতুন কৌশলে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে আবারো ভিন্ন ধাঁচের কৌশলে যাবে দল। তবে সরকারের পতন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পন্থার এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
এক্ষেত্রে আন্দোলনের গতিপথই শুধু প্রয়োজন মাফিক পাল্টাবে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলেন, দলটির একাংশের নেতাদের দাবি, এখনই সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন। তবে দলের নীতি-নির্ধারকরা সে চাওয়াকে এ মুহূর্তে আমলে নিচ্ছেন না। আন্দোলন বেগবান হচ্ছে এবং চলমান আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজপথে ফয়সালা হবে।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ঘরানায় কাজ করছে দলটি। এরই মধ্যে কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘরোয়াভাবে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ বৈঠকের ফলও পাওয়া গেছে। দেশে ও দেশের বাইরে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে। সবগুলো যোগাযোগই ব্যক্তিগত পর্যায়ে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ ফর্মুলায় চলমান। ফলে এ পর্যায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে কোনো ধরনের হঠকারী কর্মসূচি দিয়ে হিতে বিপরীত কিছু চায় না বিএনপি।
বিএনপির ওই শীর্ষ নেতারা বলছেন, নতুন বছরে মাঠ পর্যায়ে সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়ানো হবে। পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে কর্মসূচি দেয়া হবে। নাশকতা হয় এমন কোনো কর্মসূচি দেয়া যাবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা নিয়ে শান্তিপূর্ণ যত উপায় ও পদ্ধতি রয়েছে, সবগুলো অ্যাপ্লাই করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার সব বাধা-প্রতিবন্ধকতা দূর করে।
দলীয় সূত্র বলছে, অতীতে কঠোর কর্মসূচি বাস্তবায়নে খোদ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা থাকলেও সেভাবে কোনো সাফল্য আসেনি। এখন লন্ডন থেকে তারেকের নির্দেশনা এবং ঢাকার অন্যান্য নেতারা বাস্তবায়নে থাকলেও অনেকে আন্দোলনের শুরু থেকেই সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন। একইসঙ্গে ঢাকার রাজনীতিতে বিএনপির অবস্থান গড়তে না পারার বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে। তাই এবার ভেবেচিন্তে হিসাব কষে পা ফেলার নীতি নিচ্ছে দলের কমান্ডিং ফোরাম।
দলটির মধ্যমসারির গুরুরত্বপূর্ণ তিন নেতা বলেন, এখন পেছনে তাকানোর আর সুযোগ নেই বিএনপির। দেশের পরিস্থিতি ও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় বিএনপি এখন ‘ডু অর ডাই’ পজিশনে। তবে যে কোনো সময় বড় ধরনের কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলের।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, আন্দোলনে গতি বাড়ানোর অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে আরো জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি করা, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পুনর্গঠন কাজে আরো গতি আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ‘ব্যর্থ ও সন্দেহভাজন’দের সরিয়ে যোগ্য এবং জিয়া পরিবারের বিশ্বস্তদের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। চলমান আন্দোলনকে নিরপেক্ষ সরকার গঠনের আন্দোলনে রূপ দেয়া যায় কিনা তা নিয়েও কাজ করছে শীর্ষ নেতৃত্ব। পাশাপাশি সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য বা বৃহত্তর ঐক্য গঠন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করতে চায় বিএনপি।
জানা যায়, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে আগামী ১২ জানুয়ারি থেকে আরো ৩৯ সাংগঠনিক জেলায় সমাবেশ করবে বিএনপি। এসব কর্মসূচি শেষ হলে একই ইস্যুতে ফের নতুন কর্মসূচি দেয়ার কথা ভাবছে দলটি। এক্ষেত্রে কর্মসূচির ধরনে কৌশলগত পরিবর্তন আনতে চায় তারা। তবে পরিবর্তনের ধরন কী হবে তা স্পষ্ট নয়। চেয়ারপারসনের সুচিকিৎসার দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
চলমান জেলা সমাবেশ প্রসঙ্গে দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কোনো নেতার কী ভূমিকা, কার কেমন সক্ষমতা দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে যারা বিগত সময় সংসদ নির্বাচন করেছেন এবং যারা করতে চান তাদের সক্ষমতা, তৃণমূল পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের সক্ষমতাও দেখছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজে প্রতিটি কর্মসূচিতে কার কী ভূমিকা তা পর্যবেক্ষণ করছেন। এরই মধ্যে কয়েকটি জেলা কমিটির ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। ব্যর্থতার কারণে বর্তমান নেতৃত্ব সরিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলায় নতুন নেতৃত্ব আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘চলমান কর্মসূচি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পালন করছি। কিন্তু এ কর্মসূচিতে আমাদের নেত্রীর মুক্তি বা সুচিকিৎসা হচ্ছে না। কর্মসূচি আরো বেগবান হবে এবং এর মধ্য দিয়েই আন্দোলনে আমাদের দাবি পূরণ হবে বলে আশা রাখি।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, হামলা, মামলা, গুম, খুনসহ নানা নির্যাতনের কারণে যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তার অনেকটাই কেটে গেছে। বিএনপির গণজাগরণ শুরু হয়েছে। প্রতিটি কর্মসূচিতে জনস্রোত নামছে। মানুষ এখন ১৪৪ ধারারও পরোয়া করছে না। মানুষ এখন চিন্তা করতে পারছে দেশে পরিবর্তন হবে। এ-ও বিশ্বাস করছে, পরিবর্তন বিএনপির নেতৃত্বেই ঘটবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য।’
তিনি বলেন, আন্দোলনে নামার জন্য সাধারণ মানুষের গা ছটফট করছে। জনগণ কিন্তু বছরজুড়ে বা মাসব্যাপী আন্দোলন করে না। খেলার শেষ মুহূর্তে মাঠে নামবে জনগণ এবং আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। এক নেতার ডাকে সবাইকে একযোগে মাঠে নামতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘দেশের মানুষের অধিকার আদায়, সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে খালেদা জিয়া আজ মৃত্যুর পথে। তার মতো সাচ্চা জাতীয়তাবাদী নেতা, যিনি দেশের এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও সম্মতি দেননি কখনো, তিনি মরে যাবেন, আর আমরা বসে থাকব এমনটি নিশ্চয়ই হবে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেয়া না হলে সরকারের পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে।’
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ