বিএনপির ‘প্রাণশক্তি’ বলে খ্যাত জাতীয়তাবাদী যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ দেড় বছর আগে। একই অবস্থা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলেরও। প্রায় দুই বছর আগে এ সংগঠনেরও মেয়াদ শেষ হয়েছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্ব বাছাই করা হলেও দুই বছরে তারাও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেননি।
তাদের মেয়াদও শেষ হয়েছে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর। নতুন কমিটি গঠন নিয়ে চলছে আলোচনা। শুধু এই তিনটিই নয়, বিএনপির বাকি ৯টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। ফলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে এসব সংগঠন। দলীয় কর্মসূচি ও বিভিন্ন আন্দোলনেও দেখা মেলে না এসব সংগঠনের নেতাকর্মীদের। নেতৃত্বের অভাবে ধুঁকতে থাকা এসব সংগঠনকে নতুনভাবে চাঙা করতে পর্যায়ক্রমে কমিটি গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
এরই মধ্যে গত বছরে ৮ ডিসেম্বর কৃষক দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে মহানগর যুবদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। যুবদলের কমিটি ঘোষণাও আসতে শিগগিরই। চলতি বছরে ধাপে ধাপে মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, জাসাস, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, ওলামা দল ও মুক্তিযোদ্ধা দলের নতুন কমিটি দেয়া হবে। কারণ আন্দোলন সক্রিয় করতে দল ও সহযোগী সংগঠনগুলো পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলীয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সংগঠনগুলোর পদপ্রত্যাশীরা বলছেন, প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ ও করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে সংগঠনগুলোর কার্যক্রম। সব কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। এর জন্য দায়ী মূলত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও নেতৃত্ব। মেয়াদোত্তীর্ণের পরও নতুন কমিটি গঠন না হওয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা কাজ করছে। কমিটি বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে কারো কারো বিরুদ্ধে।
অবশ্য বিএনপির একাধিক নেতা জানান, নেতাকর্মীদের হতাশা কাটাতে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভেতরে ভেতরে নেতা নির্বাচনের কাজও শুরু হয়েছে। এমন খবরে অবশ্য সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে নানাভাবে লবিং-তদবির শুরু করেছেন পদপ্রত্যাশীরা। তা ছাড়া বর্তমানে ছাত্রদলের সাবেক পাঁচ শতাধিক নেতা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন, যাদের কোনো পদ নেই। তাই এদের যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের কমিটিতে স্থান দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
ছাত্রদলের গত কমিটির বহিষ্কৃতরাও দলে ফিরতে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্রনেতারা বলেন, নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতেই অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতারা কমিটি নিয়ে ভাবছেন না। ছাত্রদলের সাবেক ৫ শতাধিক নেতা এখন পদহীন পরিচয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় তারা কোথাও জায়গা পাচ্ছেন না। যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলেরও বেশ কিছু সাবেক নেতা এখন পদহীন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু নয়া শতাব্দীকে বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আবার সারাদেশের লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, অনেকে কারাগারেও আছেন। তাই সবকিছুই ভাবতে হচ্ছে। করোনা ও রাজনৈতিক নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
জানা যায়, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল মেয়াদ শেষ করেছে সুপার ফাইভ কমিটি দিয়েই। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আংশিক কমিটি ঘোষণা করে এ দুই অঙ্গসংগঠন। এ ছাড়া মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল ও ওলামা দলের কমিটি ভেঙে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেসবের মেয়াদও শেষ হয়েছে অনেক আগে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো সংগঠনই কাউন্সিল করতে পারেনি। মহিলা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। সহযোগী সংগঠনের মধ্যে শ্রমিক দলের মেয়াদ শেষ হয়েছে আরো চার বছর আগে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কমিটি গঠনে সংশ্লিষ্টদের দিকনির্দেশনাও দিচ্ছেন। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নানা অজুহাতে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করেন না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, বিএনপি সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। আমরা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতিকূল অবস্থায় দল পরিচালনা করছি। সরকারের বাধা-প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেই দল ও অঙ্গসংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চলছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়ালে নানা কার্যক্রম চলছে। তারপরও বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে।
যুবদল: সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় এক মাস পর ১১৪ সদস্যের আবার আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি সেই নেতৃত্ব। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে। সারাদেশে সাংগঠনিক ৮২ জেলা কমিটি, পৌর, থানা, উপজেলা পর্যায়েও ৭শ’টির বেশি কমিটি রয়েছে। যুবদলের এসব কমিটি গঠনে অবশ্য বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ আছে।
স্বেচ্ছাসেবক দল: ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষের এক বছর পর গত বছর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। তবে সারাদেশে সাংগঠনিক ৮১টি জেলার প্রায় সব কটিরই কমিটি সম্পন্ন হয়েছে সংগঠনটির। ছয় শতাধিক জেলা ও থানার কমিটিও হয়েছে। বর্তমানে নতুন কমিটি গঠন বিষয়ে আলোচনা চলছে। আব্দুল কাদির ভূইয়া জুয়েলকে সভাপতি করার পক্ষেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অনেকে মতামত দিয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেন সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, ইয়াসিন আলী, ফকরুল ইসলাম রবিন, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাজীব আহসানসহ বেশ কয়েকজন।
ছাত্রদল: ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিন মাস পর ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ছাত্রদল সূত্র জানায়, কমিটির মেয়াদও শেষ। বর্তমান কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হবে না। দুই-এক মাসেই আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হতে পারে। কারণ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মেয়াদ শেষ হওয়া প্রতিটি সংগঠনকে ঢেলে সাজাচ্ছেন।
মহিলা দল : আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মহিলা দলের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটিকে গত বছর ৪ এপ্রিল পূর্ণাঙ্গ করা হয়। কিন্তু একাধিক গ্রুপে বিভক্ত এ সংগঠনকে এড়িয়ে চলছেন খোদ মহিলা দলের নেতাকর্মীরা। এ সংগঠনের সাধারণ নেতাকর্মীরা এখন নারী ও শিশু অধিকার ফোরামসহ অন্যান্য সংগঠনে জড়িয়ে পড়ছেন। যুব মহিলা দল গঠনে দলের হাইকমান্ডের কাছে আবেদন-নিবেদন করছেন নেতাকর্মীরা।
শ্রমিক দল: অভ্যন্তরীণ কোন্দল-গ্রুপিংয়ে হযবরল অবস্থার শিকার মেয়াদোত্তীর্ণ শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়াতে ও সংগঠনে গতি আনতে বিএনপি নানা উদ্যোগ নিলেও তা কাজে লাগেনি। দুই বছরের কমিটি পা রেখেছে সাত বছরে। একাধিকবার সময় দিয়েও কাউন্সিল করতে পারেনি শ্রমিক দল।
জাসাস: ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারির গঠিত জাসাসের আংশিক কমিটিকে গত বছর ২৩ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ করা হয়। কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলয়ের নেতাকর্মীদের পাল্লা ভারী করার প্রতিযোগিতায় বেশির ভাগ নতুন মুখ নিয়ে আসা হয়েছে, যারা কোনো দিন এ সংগঠনে সম্পৃক্তই ছিলেন না। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারছে না জাসাস। সংগঠনের নেতাকর্মীরা নতুন কমিটির দাবিতে বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে লিখিত দাবি জানিয়ে আসছেন।
মৎস্যজীবী দল: ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ১০ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ মৎস্যজীবী দলের কমিটিকে ভেঙে সংগঠনের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মাহতাবকে আহ্বায়ক ও আবদুর রহিমকে সদস্য সচিব করা হয়। দেড় বছরের বেশি সময়েও নতুন কমিটি গঠনের ধারেকাছেও যেতে পারেননি নেতারা।
ওলামা দল: ১৪ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ ওলামা দলের কমিটি ভেঙে ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহ মো. নেছারুল হককে আহ্বায়ক এবং মাওলানা নজরুল ইসলাম তালুকদারকে সদস্য সচিব করে ১৭১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। তবে মেয়াদ শেষে এখন পর্যন্ত কমিটি দিতে পারেনি। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, শুধু মিলাদ মাহফিলের মধ্যেই সংগঠনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ তাঁতী দলের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি চায়। সে প্রস্তুতিও আমাদের আছে। এরই মধ্যে ৭০টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি সম্পন্ন করা হয়েছে। বাকি ১২টিতে রয়েছে অভ্যন্তরীণ সমস্যা।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ