বিএনপির ‘গুরুত্বপূর্ণ ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য’ নেতাদের দলীয় পদ থেকে অব্যাহতির কারণে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। সাম্প্রতি দুই প্রভাবশালী নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়ায় সিনিয়র নেতাদের মাঝে নতুন করে ভর করেছে দুশ্চিন্তা। তবে অব্যাহতির এ প্রক্রিয়া ‘নতুন নেতৃত্বের পরিবর্তনের হাওয়া’ বলছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দায়িত্বশীলরা।
তাদের মতে, বিএনপির রাজনীতিতে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ত্যাগী ও কিন ইমেজের নেতা সংকটে পড়তে পারে দল মনে করছেন নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ। দলের একাধিক নীতিনির্ধারক ও মধ্যম সারির নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে এ তথ্য।
তারা বলছেন, হঠাৎ করেই দলে ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নেতাদের সরিয়ে দেয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিএনপি। প্রথমত সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দল। দ্বিতীয়ত- ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল পর্যন্ত বিভাজন সৃষ্টি করতে সুবিধা পাবে। তৃতীয়ত, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত একাধিক দায়িত্বশীল জানান, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সামপ্রতিক সিদ্ধান্তগুলো ‘পরিবর্তনের হাওয়া’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে যারা অ্যাডজাস্ট করতে পারবে, তারাই বিএনপিতে থাকবে। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার পর তারেকের হাত ধরে বিএনপি এখন তৃতীয় জেনারেশনের নেতৃত্বে। সাম্প্রতি সিদ্ধান্তগুলো শীর্ষ পর্যায় থেকে নতুন ইঙ্গিত। এর ফলাফল এখনই স্পষ্ট হবে না।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা এও বলছেন, নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে হঠাৎ। বিষয়টি নিয়ে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়নি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঠিক কী চাইছেন, তাও স্পষ্ট নয়। দলের সিনিয়রদের মধ্যেও অস্পষ্টতা কাজ করছে।
দলের প্রভাবশালী এক নেতার দাবি, লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান ঢাকায় যাদের সঙ্গে কথা বলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকেও তাকে (তারেক রহমান) মঞ্জুকে অব্যাহতি না দিয়ে ভিন্ন কোনো উপায় গ্রহণের বিষয়ে ব্রিফ করা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলছেন, তারাই দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে ভুল বুঝিয়ে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাচ্ছেন। ফলে স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও চিন্তিত ও আতঙ্কে। এতে আদতে ক্ষতি বিএনপিরই।
দলীয় সূত্রমতে, গত ২৫ ডিসেম্বর শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে খুলনার প্রভাবশালী নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে অব্যাহতি দেয় বিএনপি। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একক সিদ্ধান্তে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। এর আগে গত ৩ নভেম্বর বরিশাল নগরীর নতুন কমিটি থেকে যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ারকে বাদ দেয়া হয়। তারও আগে গত অক্টোবরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকেও অব্যাহতি দেয়া হয়। দলীয় কার্যক্রমে তার যুক্ততা কম থাকায় তাকে বাদ দেয়া হয়েছে।
বিএনপির মধ্যম সারির গুরুত্বপূর্ণ তিন নেতা বলেন, মেয়র মনিরুল হক সাক্কু স্থানীয় ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বরিশালের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত মজিবুর রহমান সরোয়ার। নজরুল ইসলাম মঞ্জুও খুলনার রাজনীতিতে প্রভাবশালী। বড় কোনো ত্রুটি ছাড়া তাদের বাদ দেয়ার কারণে সাংগঠনিকভাবে ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। এর প্রভাব দলীয়ভাবেই টের পাবে বিএনপি।
ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা জানান, ২০১৯ সালে ছাত্রদলের ১২ কেন্দ্রীয় নেতাকে অব্যাহতি দেয়ার পর আজ অবধি তাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, এ বিষয় জানি না। আন্দাজে বলা ঠিক হবে না।
সাম্প্রতি গ্রহণযোগ্য নেতাদের অব্যাহতি দেয়ার কারণে বিএনপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এটার দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের। তিনি অসঙ্গতি দেখে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন হয়তো। আমার ব্যক্তিগতভাবে জানা নেই। কোনো মন্তব্য করতে পারবো না।
জানা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর শফিকুল আলম মনাকে আহ্বায়ক, তরিকুল ইসলাম জহিরকে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও শফিকুল আলম তুহিনকে সদস্য সচিব করে খুলনা মহানগরীতে নতুন কমিটি করে বিএনপি। প্রায় ২৯ বছর পর নগর কমিটির নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়েন নজরুল ইসলাম মঞ্জু।
খুলনায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নজরুল ইসলামকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী রকিবুল ইসলাম বকুল। হাওয়া ভবন সংশ্লিষ্ট এ নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে খুলনা মহানগরীর কমিটিতে বকুলের অনুসারীরা জায়গা পেয়েছেন। এ কমিটির নেতারা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগর লবীরও কাছের মানুষ। যদিও ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন আলী আসগর লবী।
স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতার ভাষ্য, নজরুল ইসলাম মঞ্জুও দলের দায়িত্বে আসার পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোনো সুযোগ দেননি। আলী আসগর লবী বা রকিবুল ইসলাম বকুলকেও খুব একটা পাত্তা দিতেন না তিনি। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ